রিটার্ন দেন ২৬ লাখ টিআইএনধারী, বাকি ৪৮ লাখ কোথায়

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রধান কার্যালয়
ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরেই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি নিবন্ধিত করদাতা রয়েছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশে এখন কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) ব্যক্তির সংখ্যা ৭৪ লাখ ২৪ হাজার ৩৯৭।

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ১৭ কোটি মানুষের এ দেশে এখনো নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা এক কোটি হয়নি। জনসংখ্যার অনুপাতে করদাতার হার মাত্র ৪ শতাংশের সামান্য বেশি। দক্ষিণ এশিয়ায় বৃহৎ জনসংখ্যার দেশ ভারতেই কেবল সক্রিয় করদাতার সংখ্যা কোটি পেরিয়েছে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটানের অবস্থান ভারত ও বাংলাদেশের পেছনে। অবশ্য পাকিস্তান ছাড়া অন্য দেশগুলোর জনসংখ্যাও বেশ কম।

কিন্তু পৌনে এক কোটি টিআইএনধারী নিয়ে আমরা কী করছি? পুরোপুরি সফল হতে পেরেছি? সহজ প্রশ্নটির উত্তর আরও সহজ, ‘মোটেও না’। সব টিআইএনধারীর বছর শেষে আয়–ব্যয়ের খবর জানিয়ে রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু চলতি বছরে মাত্র ২৬ লাখ করদাতা বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমা দিয়েছেন। শুধু জমি বেচাকেনা ও ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার জন্য টিআইএন থাকলেও করযোগ্য আয় না থাকলে তাঁদের রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়।

টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু সক্রিয় ও কার্যকর করদাতার সংখ্যা বাড়ছে না। টিআইএনধারীরা কেন রিটার্ন দিচ্ছেন না, তা নিয়ে এনবিআরের বারবার নোটিশ দেওয়া উচিত। এমনকি জরিমানাও করা যেতে পারে।
আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই

গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরের আগে সনাতনী পদ্ধতির টিআইএন ব্যবহার করা হতো। ওই বছর থেকে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে কর শনাক্তকরণ নম্বর (ইটিআইএন) বাধ্যতামূলক করা হয়। ওই বছর দেশে ই–টিআইএনধারীর সংখ্যা ছিল ১৭ লাখের মতো। তার বিপরীতে রিটার্ন জমা পড়েছিল ১৩ লাখের মতো। কিন্তু গত সাত বছরে ই–টিআইএনধারীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়লেও রিটার্ন জমাদানকারীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে তেমন একটা বাড়েনি।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু সক্রিয় ও কার্যকর করদাতার সংখ্যা বাড়ছে না। টিআইএনধারীরা কেন রিটার্ন দিচ্ছেন না, তা নিয়ে এনবিআরের বারবার নোটিশ দেওয়া উচিত। এমনকি জরিমানাও করা যেতে পারে।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, রিটার্ন দেওয়া মানে কর দেওয়া নয়। শূন্য রিটার্নও হতে পারে। তবে রিটার্ন দিলে করদাতাদের যেন হয়রানি করা না হয়। রিটার্নে দেওয়া তথ্য সম্পর্কে কর কর্মকর্তারা যেন অযৌক্তিক প্রশ্ন না করেন। দুই পক্ষের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করতে হবে।

এনবিআর অবশ্য টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়াতেই বেশি মনোযোগী। সে জন্য বাজেটে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেমন বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য টিআইএন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আবার বিদ্যুৎ–সংযোগ নিতে টিআইএন লাগে। এ ছাড়া গাড়ি নিবন্ধন, বাড়ির নকশা, ট্রেড লাইসেন্স নেওয়াসহ বিভিন্ন সরকারি সুবিধা নিতেও টিআইএন বাধ্যতামূলক। কিন্তু টিআইএনধারীদের সবাই যেন রিটার্ন দেন, তা নিয়ে এনবিআরকে তেমন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। যে কারণে গত সাত বছরে ই–টিআইএনধারীর সংখ্যা সাড়ে চার গুণ বৃদ্ধি পেলেও রিটার্ন জমাকারীর সংখ্যা কিন্তু দ্বিগুণও হয়নি। কর কর্মকর্তাদের সব আগ্রহ যেন টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়ানোর মধ্যেই সীমিত।

আবার রিটার্ন কারা দেবেন, তা নিয়েও আয়কর অধ্যাদেশে অস্পষ্টতা আছে। বছর দুয়েক আগে ১২ সংখ্যার ই–টিআইএনধারী সবার জন্য রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু আয়কর অধ্যাদেশে আবার বলা হয়েছে, ১২ সংখ্যার টিআইএনধারীর পাশাপাশি আরও ৩৬ ধরনের টিআইএনধারীর রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ আয়কর অধ্যাদেশে পরিষ্কার ব্যাখ্যা নেই। একদিকে বলা হচ্ছে, সব টিআইএনধারীকে রিটার্ন দিতে হবে। অন্যদিকে আবার বলা হচ্ছে, বিশেষ ধরনের টিআইএনধারীদের অবশ্যই রিটার্ন দিতে হবে। যেমন কোম্পানির পরিচালক, অভিজাত ক্লাবের সদস্য, গাড়ির মালিক, ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া ব্যক্তি, ব্যবসায়িক সংগঠনের সদস্য, ঠিকাদার, বাড়ির মালিক, সঞ্চয়পত্রে দুই লাখ টাকার বেশি অর্থ বিনিয়োগকারী।

প্রতিবেশী ভারতে দেড় কোটির বেশি করদাতা রিটার্ন দেন। এ ছাড়া পাকিস্তানে ২৫ লাখ, শ্রীলঙ্কায় ১৫ লাখ, নেপালে ২২ লাখ, ভুটানে ৮৮ হাজার করদাতা আয়কর রিটার্ন জমা দেন।

কর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সরকারি বিভিন্ন কাজে এখন টিআইএন লাগে। তাই অনেকে টিআইএন নিয়ে থাকেন। পরে আর রিটার্ন জমা দেন না। এ প্রবণতা শুধু বাংলাদেশ নয়; পার্শ্ববর্তী ভারতসহ বিভিন্ন দেশেও নিবন্ধিত করদাতাদের সবাই রিটার্ন দেন না।

বাংলাদেশে টিআইএন নেওয়া বেশ সহজ। যখনই সরকারি কোনো কাজে টিআইএন দরকার হয়, তখন যে কেউ ঘরে বসেই টিআইএন নিতে পারেন। শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) থাকলেই হলো। কিন্তু টিআইএন নিয়ে বছর শেষে বেশির ভাগ মানুষই রিটার্ন জমা দেন না। টিআইএনধারীর সংখ্যা বৃদ্ধির এটিও অন্যতম কারণ। আর টিআইএন নিতে কোনো টাকা দিতে হয় না। ঘরে বসে অনলাইনে নির্ধারিত ফরম পূরণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটি নেওয়া যায়। এনআইডি নম্বর দিলে অনলাইন সিস্টেম তা যাচাই–বাছাই করে স্বয়ংক্রিয় উপায়ে টিআইএন কপি ই–মেইলে পাঠিয়ে দেয়।

ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবেশী ভারতে দেড় কোটির বেশি করদাতা রিটার্ন দেন। এ ছাড়া পাকিস্তানে ২৫ লাখ, শ্রীলঙ্কায় ১৫ লাখ, নেপালে ২২ লাখ, ভুটানে ৮৮ হাজার করদাতা আয়কর রিটার্ন জমা দেন।