শিকাগোর ছায়া খাতুনগঞ্জের পাইকারি মোকামে

যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে অবস্থিত কমোডিটি এক্সচেঞ্জ শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে (সিবিওটি) পণ্যের দর বাড়লে খাতুনগঞ্জেও বাড়ে।

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারী বাজার।
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

দুপুর ২টা। পণ্যবোঝাই সারি সারি ট্রাকের জট পেরিয়ে পৌঁছালাম দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের বড় পাইকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আরএম এন্টারপ্রাইজে। প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে ঢুকেই দেখা গেল, পণ্য বেচাকেনার ফাঁকে মুঠোফোনে একটি অ্যাপে বারবার চোখ রাখছিলেন ব্যবসায়ী শাহেদ উল আলম।

অ্যাপটিতে তিনি অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, চিনি ও গমের মতো পণ্য। আঙুল ছোঁয়ানোমাত্র মুঠোফোনের পর্দায় ভেসে ওঠে এসব পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারের দর। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে প্রতিষ্ঠিত কমোডিটি এক্সচেঞ্জ শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে (সিবিওটি) কোন পণ্যের কত দর উঠল তা খাতুনগঞ্জে বসে সহজেই জেনে যাচ্ছেন তিনি।

যাঁরা আরএম এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে পণ্যের লেনদেন করতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে এসেছেন, তাঁরাও মুঠোফোনে ফাঁকে ফাঁকে শিকাগোর কমোডিটি এক্সচেঞ্জ বোর্ডে পণ্যের দরের ওঠানামায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন। তাঁদেরই একজন জনি চন্দ্র সাহা। তিনি মূলত আরএম এন্টারপ্রাইজ থেকে পণ্য কিনে ছোট ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। তিনি জানান, শিকাগো কমোডিটি এক্সচেঞ্জের অ্যাপের মাধ্যমে মুহূর্তেই বিশ্ববাজারের পণ্যের দাম জানা যায়।

জানা যায়, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম যাচাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বোর্ডের পণ্য লেনদেনের হিসাবটা বেশি আমলে নেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। বিশ্বের বড় এই কমোডিটি এক্সচেঞ্জের কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যের দরই বেশি প্রভাব ফেলে এই বাজারে। ১৮৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত সিবিওটি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ফিউচার ও অপশনস এক্সচেঞ্জের একটি। সিবিওটি ছাড়া পাম তেলের দাম যাচাইয়ের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার বুশরা ডেরিভেটিভস বাজারকে বিবেচনায় নেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা।

শেয়ারবাজারের মতো কমোডিটি এক্সচেঞ্জেও পণ্যের দাম বাড়লে, সবুজ রঙে কত বাড়ল এবং কত শতাংশ বাড়ল তা প্রকাশ করা হয়। আর দাম কমলে তা প্রকাশ করা হয় লাল রঙে। মুহূর্তেই দামের উত্থান–পতনের সেই তথ্য ভেসে ওঠে মুঠোফোনের পর্দায়।

খাতুনগঞ্জে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বোর্ডের পণ্য লেনদেনের কী সম্পর্ক জানতে চাইলে আরএম এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার শাহেদ উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, খাতুনগঞ্জে দর ওঠানামার সঙ্গে শিকাগো বোর্ডের দর ওঠানামার ছায়া আছে। সয়াবিন তেলের দাম যখন খাতুনগঞ্জে বেড়েছিল, তখন কিন্তু শিকাগো বোর্ডেও বেড়েছিল। শিকাগোতে বাজার সংশোধন হওয়ায় এখানেও প্রভাব পড়েছে।

খাতুনগঞ্জে পণ্যের হাতবদল হয় ‘এসও’ বা সরবরাহ আদেশ বেচাকেনার মাধ্যমে। আমদানিকারক বা কারখানা মালিক এই এসও বিক্রি করেন। পণ্য থাকে কারখানা বা গুদামে। হাতবদল হয়ে এসও যাঁর কাছে থাকবে, সেই হবেন পণ্যের মালিক। পরে ওই এসও দেখিয়ে গুদাম বা কারখানা থেকে পণ্য খালাস করে নেন ব্যবসায়ীরা।

কমোডিটি এক্সেচেঞ্জে লেনদেন হয় ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে। শেয়ারবাজারের মতোই লেনদেননিষ্পত্তি হওয়ার পর পণ্য বুঝে নিতে হয়। কমোডিটি এক্সচেঞ্জে পণ্যের আগাম বেচাকেনা হয়। এক মাস, দুই মাস কিংবা ছয় মাস পরও পণ্য সরবরাহ করা হয়।

বাংলাদেশে পণ্য বেচাকেনার জন্য আলাদা কোনো কমোডিটি এক্সচেঞ্জ নেই। তবে কমোডিটি এক্সচেঞ্জের মতো না হলেও চা বেচাকেনার জন্য আলাদা নিলাম কেন্দ্র আছে। সেখানে সরেজমিনে অংশ নিয়ে চা কেনাবেচা করতে হয়। তবে গত বছরের অক্টোবরে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠায় চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠার কাজটি এখনো সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর্যায়ে রয়েছে।

খাতুনগঞ্জে ভোগ্যপণ্য বেচাকেনার ক্ষেত্রে শিকাগো কমোডিটি এক্সচেঞ্জের প্রভাব চলে আসছে এক দশক আগে থেকে। এখন রীতিমতো তা জনপ্রিয়। এক দশক আগে পণ্যের দাম নির্ধারণে প্রভাব ফেলত বন্দরে কোন পণ্য কত দামে আসছে তার ওপর। এ জন্য স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার পাতায় বন্দরে জাহাজ আসার খবরাখবর ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন এখন আর নেই বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

খাতুনগঞ্জের সোনা মিঞা মার্কেটে দেখা পাওয়া গেল আবু তৈয়ব ও মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন নামের দুজন ব্যবসায়ীর। বড় আমদানিকারকদের কাছ থেকে পণ্য কিনে ছোট পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন তাঁরা। গত মঙ্গলবার মুঠোফোনে শিকাগো কমোডিটি এক্সচেঞ্জের লেনদেনের তথ্য দেখিয়ে আবু তৈয়ব প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিকাগো এক্সচেঞ্জে মঙ্গলবার গমের দাম সাড়ে ৩ শতাংশ বেড়েছে। খাতুনগঞ্জেও বেড়েছে ৩ শতাংশ। আবার কয়েক দিন আগে শিকাগোতে দাম যখন কমেছিল, এখানেও কমতির দিকে ছিল।’ রোকন উদ্দিন জানান, ‘আমরা পণ্য কেনাবেচার আগে সিবিওটির অ্যাপে দেখে নিই পণ্যের দর লাল না সবুজ আছে।’