সক্ষমতা বাড়াতে বেশি মনোযোগী হতে হবে

এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশের জন্য এবার তিনটি সূচকেই মান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তিন বছর আগেও তিনটিতেই মান অর্জন করেছিল।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হতে তিন সূচকেই মান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। সূচক তিনটি হলো পরিবেশ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, মানবসম্পদ এবং মাথাপিছু আয়। তিন বছর আগেও তিনটিতেই মান অর্জন করেছে এ দেশ। কিন্তু ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ভঙ্গুরতার ঝুঁকি সূচকে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে, যা অর্থনৈতিক সক্ষমতার দুর্বলতা প্রকাশ করে। বাকি দুটি সূচকে অবস্থার উন্নতি হয়েছে।

গতকাল রোববার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের সঙ্গে অনলাইনে আলাপচারিতায় এসব তথ্য দেন। পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে ওই তিনটি সূচকে নির্দিষ্ট মান অর্জন করলে এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করে থাকে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। সিডিপির সদস্য হলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ বছর বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করেছে সিডিপি। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হয়ে যাবে বাংলাদেশ।

গতকালের আলোচনায় দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য একটি উপস্থাপনা দেন। সেখানে গত তিন বছরে ওই তিন সূচকে কোনটিতে কতটা অগ্রগতি হলো, তা দেখানো হয়েছে। এবারের মূল্যায়ন অনুযায়ী অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে বাংলাদেশের ২৭ পয়েন্ট রয়েছে। ৩ বছর আগে এ সূচকে পয়েন্ট ছিল ২৫। তিন বছরের ব্যবধানে এ সূচকে অবনতি প্রায় ১৫ শতাংশের বেশি। অবশ্য এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে এ সূচকে ৩২ পয়েন্ট বা এর নিচে থাকতে হবে। এ বিষয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে আগের চেয়ে খারাপ অবস্থানে গেছে বাংলাদেশ। এ সক্ষমতা কমে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।

মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ বা এর বেশি পয়েন্ট পেতে হবে। এ সূচকে উন্নতি হয়েছে। ২০২১ সালের মূল্যায়নে এ সূচকে বাংলাদেশের রয়েছে ৭৫ দশমিক ৪ পয়েন্ট। ২০১৮ সালে ছিল ৭৩ দশমিক ২ পয়েন্ট। অন্যদিকে মাথাপিছু আয় সূচকে ১ হাজার ২২২ মার্কিন ডলার থাকতে হবে। এবারের মূল্যায়নে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৮২৭ ডলার হয়েছে, যা ৩ বছর আগের চেয়ে ৫৫৩ ডলার বেশি। মাথাপিছু আয় হিসাবটি জাতিসংঘ করেছে এটলাস পদ্ধতিতে। সেখানে মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন বিষয় সমন্বয় করে তিন বছরের গড় হিসাব করা হয়।

যেসব সমস্যা হতে পারে

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানান, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পর শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা প্রত্যাহার হলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৮ থেকে ১০ শতাংশ কমতে পারে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পরপর ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যসুবিধাগুলো হারাবে বাংলাদেশ। যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নে উত্তরণের পরও বাড়তি তিন বছর শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা থাকবে। এ বিষয়ে তাঁর মতে, এলডিসি থেকে বের হলে রপ্তানি খাতের নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টিই বেশি আলোচনায় আসে। অন্য প্রভাবের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় একধরনের অনীহা আছে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, আরও কয়েকটি বিষয়ে সমস্যায় পড়তে পারে বাংলাদেশ। যেমন ওষুধশিল্পের ওপর কড়াকড়ি শর্ত আরোপ হতে পারে। সহজ শর্তের ঋণ বা বিদেশি সাহায্য পাওয়া কঠিন হবে। কৃষি খাতে ভর্তুকি আরও স্বচ্ছ ও সীমিত হতে পারে। নতুন শিল্পকে প্রণোদনা দেওয়ার শর্ত কঠিন হবে।

বাংলাদেশের কী করা উচিত

এলডিসি থেকে মসৃণ উত্তরণের পথে বাংলাদেশের কী করা উচিত, তা নিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এ দেশে আলোচনাগুলো বেখাপ্পা মনে হয়। বিদেশ থেকে কীভাবে বেশি সাহায্য-সহায়তা পাব, এ নিয়েই বেশি আলোচনা হয়। কিন্তু কোন কোন সমস্যার কারণে এ সাহায্য নিতে হচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা বেশি হয় না। সমস্যাগুলো সমাধানে বেশি মনোযোগী হই না।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও যদি বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাই, তাহলে ভুল হবে। বিশেষ সুবিধাকে বাড়তি পাওনা হিসেবে দেখতে হবে। তবে দেশের অভ্যন্তরে সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে বেশি মনোযোগী হতে হবে।’ এ জন্য দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তিনটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এগুলো হলো ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়াতে পরিবেশ সৃষ্টি করা; কর আহরণ বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি।

এ ছাড়া এলডিসি থেকে মসৃণ উত্তরণের জন্য একটি উত্তরণকালীন কৌশলপত্র তৈরির সুপারিশও করেছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সুপারিশ হলো বাণিজ্যসুবিধাগুলো ধরে রাখতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে আরও সমন্বয় করা। এ জন্য এলডিসি উত্তরণে গঠিত টাস্কফোর্সে পররাষ্ট্র, বাণিজ্য ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে আরও বেশি সম্পৃক্ত করার তাগিদ দেন তিনি।

জাতিসংঘ যা করছে

করোনা পরিস্থিতিসহ অন্যান্য কারণে এলডিসি থেকে মসৃণভাবে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের সিডিপি তিন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এগুলো হলো এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে আন্তর্জাতিক সাহায্য–সহযোগিতা অব্যাহত রাখার উদ্যোগ; কোনো দেশ অসুবিধায় পড়ল কি না, তা তদারকিতে রাখতে বিশেষ পর্যবেক্ষণব্যবস্থা চালু এবং এলডিসি উত্তরণ সহায়তা কর্মসূচি চালু।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানতে চায়, উত্তরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশসহ এলডিসিগুলোতে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন হচ্ছে কি না, উন্নয়ন কতটা টেকসই হচ্ছে

এবং বৈষম্য হ্রাস পাচ্ছে কি না। অবশ্য বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়ছে। এ ছাড়া সুশাসন বিষয়েও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর আছে। তারা নিশ্চিত হতে চায়, তাদের পক্ষ থেকে স্বল্পোন্নত দেশকে যেসব সুবিধা দেওয়া হয়, তা পিছিয়ে পড়া মানুষের কাজে লাগছে কি না।