সম্ভাবনার ব্যবসায় সহায়তার আশা

সম্ভাবনা থাকায় পুরোনো প্রতিষ্ঠান ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে, নতুন বিনিয়োগও আসতে শুরু করেছে।

করোনাভাইরাসের শুরুতে ঘরবন্দী মানুষ চাল-ডাল-মাছ-মাংসের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি সুরক্ষাসামগ্রী, ওষুধ, ইলেকট্রনিক পণ্য অনলাইনে কিনতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এতে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবসাও বাড়তে থাকে। করোনা পরিস্থিতির ওঠানামার ওপর অনলাইনভিত্তিক বেচাবিক্রিও ওঠানামা করে। তবে অনলাইনে কেনাকাটায় মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এতে এই খাতের সম্ভাবনাও বাড়ছে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, করোনাকালে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসার যে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেটি ধরে রাখতে বাজেটে কর অবকাশ সুবিধা, কয়েক বছরের জন্য ভ্যাট অব্যাহতির মতো নীতিসহায়তা দেওয়া দরকার। তাহলে পুরোনোদের পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করবে। তাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

জানা যায়, দেশে ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩ লাখের বেশি। এগুলোর মধ্যে ৫০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী নারী। প্রতিষ্ঠানগুলো মাসে ১০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করে। সব মিলিয়ে ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসার পরিমাণ বর্তমানে ৩৫০ কোটি টাকার বেশি। অন্যদিকে ই-কমার্সভিত্তিক ব্যবসার আকার ২০৭ কোটি ডলারের বা ১৭ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকার। এখানে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। তারা সম্মিলিতভাবে প্রতিদিন ৩০ হাজার ক্রয়াদেশ সরবরাহ করছে সারা দেশে। ই-কমার্সের ক্রেতাদের ৮০ শতাংশ শহরকেন্দ্রিক।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখতে অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান রয়েছে। করোনা-পরবর্তী সময়ে তাদের ব্যবসা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকার বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। এই খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বিকশিত হওয়ার জন্য বাজেটে ৫-৭ বছরের কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া যায়। তা ছাড়া নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সহজ শর্তে ভর্তুকি সুদহারে ঋণ দেওয়ার জন্য বরাদ্দ রাখা যেতে পারে।

উদ্যোক্তারা যা চাচ্ছেন

২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করা অনলাইন সুপারশপ ‘চালডাল ডটকম’ গত এক বছরে ব্যবসা বাড়িয়েছে কয়েক গুণ। করোনার আগে প্রতিষ্ঠানটি দিনে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার ক্রয়াদেশ পেত। এই মহামারির প্রথম ঢেউয়ের শুরুতে অর্থাৎ গত বছরের এপ্রিলে সেই ক্রয়াদেশ বেড়ে ১৬ হাজারে দাঁড়ায়। বর্তমানে দৈনিক ক্রয়াদেশ ৯-১০ হাজার।

ব্যবসা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি চালডাল ডটকমের লোকবলও বেড়েছে। গত বছরের মার্চে তাদের কর্মীর সংখ্যা ছিল ৭০০। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির লোকবলের সংখ্যা ৩ হাজারের কাছাকাছি। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, যশোর ও নারায়ণগঞ্জেও ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে এই অনলাইন সুপারশপ।

চালডাল ডটকমের পরিচালক ইশরাত জাহান প্রথম আলোকে বলেন, অনলাইন সুপারশপের জন্য বড় আকারের ওয়্যারহাউস বা গুদামের প্রয়োজন হয়। ওয়্যারহাউসের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার করা হলে এই খাত দ্রুত বিকশিত হবে।

করোনাকালে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখতে অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান রয়েছে। করোনা-পরবর্তী সময়ে তাদের ব্যবসা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকার বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি

২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করে ই-কুরিয়ার। করোনার আগে দিনে ১২-১৩ হাজার পার্সেল ব্যবস্থাপনা করত প্রতিষ্ঠানটি। করোনায় তাদের ব্যবসাও বেড়েছে। বর্তমানে দিনে ২৪-২৬ হাজার পার্সেল ব্যবস্থাপনা করছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির লোকবলের সংখ্যাও ৪০০-৪৫০ থেকে বেড়ে এখন ১ হাজার ৬০০ জনে উন্নীত হয়েছে।

ই-কুরিয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিপ্লব ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অনলাইনভিত্তিক সেবা দিয়ে থাকি। সে কারণে কুরিয়ার সেবার ওপর ভ্যাট ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ৪ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ করা দরকার। তা ছাড়া ওয়্যারহাউস বা গুদাম ভাড়ার ওপর ভ্যাট মওকুফ করলে ব্যবসা সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থান দ্রুত বাড়ত।’

করোনাকালে অনলাইনে পোশাক কেনার হারও বেড়েছে। গত বছর কঠোর লকডাউনে দোকানপাট বন্ধ থাকায় অনেক ক্রেতাই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ই-কমার্স সাইটে ভিড় করেছেন। ফেসবুকভিত্তিক উদ্যোক্তাদের পোশাকও বিক্রি হচ্ছে বেশ।

রঙ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী সৌমিক দাশ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার আগে অনলাইনে দু-চারটি ব্র্যান্ড ছাড়া অন্যদের বিক্রি ছিল টুকটাক। তবে গত এক বছরে মোট বিক্রির ৫-১০ শতাংশে পৌঁছেছে অনেকের। আমাদের জন্য অনলাইন ব্যবসাটি নতুন। তা ছাড়া প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। সে কারণে অনেকে ইচ্ছা সত্ত্বেও অনলাইনে ভালো করতে পারছে না। অনলাইন বিক্রির ভিত্তি শক্ত করতে ভ্যাটের হার কমানো প্রয়োজন।’

কত টাকার বাজার

দেশের অনলাইনভিত্তিক ফ্যাশন মার্কেটের আকার বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার। ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকায়। আর সোয়া ২ হাজার কোটি টাকার খেলনা ও শখের পণ্যের বাজার বেড়ে হবে পৌনে ৪ হাজার কোটি টাকায়।

এমন তথ্য দিয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির প্রথম আলোকে বলেন, ই-কমার্স ব্যবসা থেকে ভ্যাট উঠিয়ে নিলে ক্রেতারা নগদ টাকাবিহীন লেনদেনের প্রতি ঝুঁকবে। এ ছাড়া স্টার্টআপদের উৎসাহ দিতে তিন থেকে পাঁচ বছর কর অবকাশ সুবিধা দিতে হবে। আর ফেসবুকভিত্তিক অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য এখনই ভ্যাট ও ট্রেড লাইসেন্সের বাধ্যতামূলক করার মতো কড়াকড়ি আরোপ করা ঠিক হবে না। তাদের আরও তিন থেকে পাঁচ বছর সুবিধা দেওয়া দরকার। ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসায়ীদের ৫০ শতাংশ নারী। তাঁদের অধিকাংশই ঘরে বসে ব্যবসা করছেন।

সৈয়দ আলমাস কবির আরও বলেন, করোনাকালে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে। তাই ইন্টারনেটকে পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়। এটি কাঁচামাল। ইন্টারনেটের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার এবং যেসব প্রতিষ্ঠান সেবাটি দেয়, তাদের করপোরেট কর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনলে নতুন ব্যবসা হবে। তাতে শুরুতে সরকার কিছুটা রাজস্ব হারালেও পরে ব্যাপক হারে বাড়বে।