সরকারি মাল, নদীর পাড়ে ঢাল

নিলামে মাটি বিক্রি করলে সরকার টাকা পেত কিংবা বিনা পয়সায় দিলেও মানুষ নিয়ে নিত। তাতে সরকারি অর্থের অপচয় ঘটত না।

  • উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় টাকা দিয়েও মাটি মিলছে না। অথচ বিআইডব্লিউটিএ টাকা দিয়ে মাটি সরাচ্ছে।

  • ঠিকাদারেরা সরকারের কাছ থেকেও টাকা পাচ্ছেন, মাটি বিক্রি করেও পাচ্ছেন।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন করতে গিয়ে সরকার মাটির সংকটে পড়েছিল। আবার সারা দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর জমি ভরাট করতে মাটির জন্য বেগ পেতে হচ্ছে ঠিকাদারদের। নতুন রাস্তা নির্মাণেও মাটি খুঁজতে হচ্ছে সরকারকে। অথচ ঢাকার চারপাশে চারটি নদ–নদীর পাড় থেকে ১৮ লাখ ঘনমিটার মাটি সরাতে উল্টো ২২ কোটি টাকা খরচ করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এ যেন ‘সরকার কা মাল, দরিয়া মে ঢাল’।

সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সবাই যেখানে টাকা নিয়ে মাটির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে, সেখানে বিআইডব্লিউটিএ সরকারি কোষাগারের টাকা অপচয় করে মাটি সরাচ্ছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের ওপর নজরদারি করার একমাত্র সংস্থাটি বলেছে, ঢাকার চারপাশে চারটি নদ–নদীর তীর থেকে মাটি সরানোর জন্য ইতিমধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রতি ট্রলার মাটি ৮০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করছে। এতে ঠিকাদার দুভাবেই লাভবান হচ্ছেন। একদিকে সরকারি কোষাগার থেকে টাকা পাচ্ছেন, অন্যদিকে মাটি বিক্রি করেও টাকা পাচ্ছেন।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার চারপাশের চারটি নদ–নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে রক্ষা করতে ২০১৮ সালে একটি প্রকল্প অনুমোদন করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। চার নদ–নদীর তীরে পিলার স্থাপন, তীর রক্ষা, ওয়াকওয়ে নির্মাণসহ পরিবেশের উন্নয়নে ৮৪৮ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়, যেটি আগামী বছর জুনে শেষ হওয়ার কথা।

আড়াই বছরে প্রকল্পটির অগ্রগতি কতটুকু, তা দেখতে আইএমইডির একটি প্রতিনিধিদল গত ৮ ফেব্রুয়ারি সরেজমিন পরিদর্শনে যায়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদলটির জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই প্রকল্পে ১৮ লাখ ২১ হাজার ঘনমিটার মাটি সরাতে কেএসএল ও এসএসআরই নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতি ঘনমিটার মাটি সরাতে খরচ হবে ১২০ টাকা। সেই হিসাবে ১৮ লাখ ২১ হাজার ঘনমিটার মাটি সরাতে খরচ হবে প্রায় ২২ কোটি টাকা।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই মাটিগুলো নিলামে বিক্রি করা গেলে সরকারি কোষাগারে টাকা জমা হতো। অথবা নিলামে কেউ সাড়া না দিলে মাটিগুলো বিনা মূল্যেও দেওয়া যেত। এতে সরকারের ২২ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। মাটি সরানোর জন্য ঠিকাদার নিয়োগ কিছুতেই সমীচীন হয়নি। এই মাটি সরানোর প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে আইএমইডি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পটির আওতায় নদ–নদীর পাড়ে কৃষ্ণচূড়া, বকুল, কাঠগোলাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা লাগিয়ে বনায়ন করা হলেও এর অধিকাংশই মরে যাচ্ছে। রামচন্দ্রপুর থেকে বসিলা পর্যন্ত সাড়ে তিন কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণেও দেশের একটি অখ্যাত ব্র্যান্ডের সিমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর ঢাকা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপপ্রকল্প পরিচালক মতিউল ইসলাম বলেন, ‘১৮ লাখ ২১ হাজার ঘনমিটার মাটি অন্য কোনো কাজে ব্যবহারের মতো অবস্থায় নেই। সে কারণে আমরা মাটি সরাতে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছি।’ ওই মাটি যদি ব্যবহারের উপযোগী না হয়ে থাকে, তাহলে ঠিকাদার কীভাবে একই মাটি বিক্রি করছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঠিকাদার যে মাটি বিক্রি করছেন, সেটি আমার জানা নেই।’

নদীর পাড়ে লাগানো গাছ নষ্ট হওয়ার তথ্য স্বীকার করে মতিউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যথেষ্ট পরিচর্যা করতে পারিনি। তাই গাছ মারা যাচ্ছে।’ আর ওয়াকওয়ে নির্মাণে কম প্রচলিত কোম্পানির সিমেন্ট ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঠিকাদার যদি দুই টাকা কমে সিমেন্ট পায় এবং সেই সিমেন্টে যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সব গুণ পাওয়া যায়, তখন তো আমরা তাদের বাধা দিতে পারি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আইএমইডির প্রতিবেদন আমরা হাতে পেয়েছি। আমরা তাদের জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

এদিকে আইএমইডির প্রতিবেদনটি এমন এক সময়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে, যখন বিআইডব্লিউটিএ প্রকল্পটির ব্যয় ৮৪৮ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ১৮১ কোটি টাকা করার প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ প্রকল্পের ব্যয় ৩৩২ কোটি টাকা বৃদ্ধির পাশাপাশি এর মেয়াদও ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। তবে বিআইডব্লিউটিএর প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়নি। বরং কেন রাষ্ট্রীয় টাকা খরচ করে মাটি সরাতে হচ্ছে, তার কারণ জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি সংশোধন না করে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া সরকারের পরিকল্পনা শৃঙ্খলার পরিপন্থী। বিনা পয়সায় মাটি না ছেড়ে কেন ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হলো, তার কারণ জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।

উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে মাটি ভরাটের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের সঙ্গে তাঁর ঢাকার মতিঝিলের অফিসে সম্প্রতি কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পতিত জমিতে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হলে সেখানে ভূমি উন্নয়নে প্রচুর মাটির প্রয়োজন হয়। সরকার সারা দেশে যেসব অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে, সেগুলোতেও প্রচুর পরিমাণে মাটির প্রয়োজন হচ্ছে। সরকারি বা বেসরকারি দুই পর্যায়েই সবাই নিজের টাকা খরচ করে মাটি কিনছে। অথচ এখানে উল্টো মাটি সরানোর জন্য রাষ্ট্রের টাকা খরচ করা হয়েছে। এখানে রহস্যজনক কিছু তো আছে মনে হচ্ছে।

এদিকে গত আড়াই বছরে বিআইডব্লিউটিএর ৮৪৮ কোটি টাকার প্রকল্পে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৭৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।