সরকারের নদী খননকাজে সরকারি সংস্থাই বাধা

  • বিআইডব্লিউটিএর নেওয়া নদী খননের কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা ও অতীতের অদূরদর্শী কার্যক্রমের কারণে।

  • স্থানীয় প্রভাবশালীরা বালুমহাল ইজারা নেওয়ায় খনন করা যাচ্ছে না।

  • বহু সেতুর উচ্চতা কম। সেগুলোর নিচ দিয়ে ড্রেজার নেওয়া যায় না।

সারা বছর নদীতে পানির প্রবাহ ধরে রাখতে সরকার নদী খননের (ক্যাপিটাল ড্রেজিং) যে কর্মসূচি নিয়েছে, তা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে খোদ সরকারের অন্য কোনো সংস্থা বা কার্যক্রম। যেমন কোথাও বালুমহালের ইজারাসংক্রান্ত জটিলতার কারণে নদী খনন বন্ধ থাকছে। কোথাও-বা কম উচ্চতার সেতু নির্মাণ করায় তার নিচ দিয়ে এখন ড্রেজার নেওয়া যাচ্ছে না। আবার কোথাও কোথাও নদী খনন করতে গেলে বাধা আসে স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছ থেকে, যারা বছরের পর বছর নদী দখল করে আছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক সরেজমিন প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, নদীভাঙন রোধের পাশাপাশি নদীতে পানির প্রবাহ ধরে রাখতে নেওয়া প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারমূলক এই প্রকল্প বাধার মুখে পড়েছে। এতে বছরের পর বছর পার হচ্ছে, কিন্তু নদী খননের কাজ শেষ হচ্ছে না।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ৫৩টি অভ্যন্তরীণ নৌপথ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ২৪টি নৌপথ খনন করতে সরকার ২০১২ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। ১ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকার এই প্রকল্প ২০১৮ সালেই শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু নদী খনন করতে গিয়ে পদে পদে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। সে জন্য দুই দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর অর্থাৎ ২০২২ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। তা পরিকল্পনা কমিশন অনুমোদন করলে ১ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকার প্রকল্প গিয়ে ঠেকবে ১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকায়।

বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বছরের জুনে নদী খননের পুরো কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এ সময়ে তা শেষ করা সম্ভব নয়। তাই আমরা আরও এক বছর সময় চেয়ে পরিকল্পনা কমিশনে আবেদন করেছি। আশা করছি, এবার আমরা কাজ শেষ করতে পারব।’

৯ বছরে নদী খননের কাজে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তা দেখতে গত মাসে আইএমইডির একটি প্রতিনিধিদল কয়েকটি নৌপথে সরেজমিন পরিদর্শনে যায়। তখন প্রতিনিধিদলটির চোখে এই প্রকল্পের নানা সমস্যা ধরা পড়ে।

বালুমহাল ইজারায় জটিলতা

আইএমইডির সরেজমিন প্রতিবেদনে বলা হয়, বিআইডব্লিউটিএ মানিকগঞ্জে ধলেশ্বরী নদীর হজরতপুর-জাবরা এলাকায় খনন করতে গিয়ে জানতে পারে, নদীর সেই জায়গাটি বালুমহাল হিসেবে ইজারা দিয়ে রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন। তাই বালুমহাল ইজারা নেওয়াদের পক্ষ নদী খননে বাধা দিয়েছে। ওই এলাকায় নদী খনন না করার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।

বালুমহাল ইজারাসংক্রান্ত জটিলতার কারণে মৌলভীবাজারের মনু নদ; পাবনা ও নাটোর জেলায় আত্রাই নদ খনন করতে গিয়েও একই ধরনের সমস্যায় পড়েছে বিআইডব্লিউটিএ। এসব জেলার স্থানীয় প্রশাসন ও ইজারা নেওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করতেই কেটে যায় বছর। একই কারণে দিনাজপুরেও আত্রাই নদের ড্রেজিং কাজ প্রায় সময় বন্ধ থাকে।

এ প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা জানান, যারা বালুমহাল ইজারা পেয়েছে, তারা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। জেলা প্রশাসকেরা চাইলেই তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে পারেন না। আবার স্থানীয় প্রশাসনের আয়ের বড় একটি উৎসও হচ্ছে এই বালুমহাল ইজারা। তাই চুক্তি বাতিল করা কঠিন। সে জন্য ইজারাদারের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে সমস্যার সমাধান করতে হচ্ছে।

সেতুর উচ্চতা কম

আইএমইডির প্রতিবেদন বলছে, অনেক নদীর ওপর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) নির্মিত সেতুগুলোর উচ্চতা কম। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়াই ভুল নকশায় সেতু তৈরি করায় ওই সব সেতুর নিচ দিয়ে বর্ষা মৌসুমে পানি বেশি থাকায়, আবার শুষ্ক মৌসুমে পানি কম বা না থাকায় ড্রেজার নেওয়া যায় না। ফলে ড্রেজারের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি খুলে সড়কপথে নদীর অপর পাশে নিয়ে আবার তা লাগিয়ে কাজ করতে হয়। এতে অনেক সময় চলে যায়।
প্রতিবেদনে উদাহরণও দেওয়া হয়েছে। যেমন আশুলিয়ার ধউর সেতুর নিচ দিয়ে বর্ষায় ড্রেজার নেওয়া যায় না, আবার শুষ্ক মৌসুমে স্পিডবোটও চলে না। একই ঘটনা ঘটছে নেত্রকোনার কংস নদে। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ২০১৯ সালে নেত্রকোনায় গিয়ে কংস নদে খননকাজের উদ্বোধন করেন। কিন্তু সেতুর উচ্চতা কম হওয়ায় ড্রেজার নেওয়া যাচ্ছে না। একইভাবে দিনাজপুরে আত্রাইসহ ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও শেরপুর জেলায় কয়েকটি নাদ-নদীতে সেতুর উচ্চতা কম হওয়ায় ড্রেজিং নেওয়া যাচ্ছে না। এসব নদ-নদীতে কেবল অক্টোবর ও নভেম্বর—এই দুই মাসে কাজ করা যায়।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ২০০৬ সালের আগে এলজিইডি ও সওজ সারা দেশে যেসব সেতু নির্মাণ করেছে, সেসব সেতু নির্মাণের আগে বিআইডব্লিউটিএর অনুমোদন নেয়নি। যে কারণে সেতুর উচ্চতা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে। তিনি জানান, ২০০৬ সালের পর থেকে সেতু নির্মাণে বিআইডব্লিউটিএর অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

আইএমইডির প্রতিবেদন বলছে, নরসিংদী ও কিশোরগঞ্জ জেলা দিয়ে প্রবাহিত আড়িয়াল খাঁ ও পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের মরে যাওয়া অংশগুলো স্থানীয় প্রভাবশালীরা ২৫-৩০ বছর ধরে দখল করে রেখেছে। তাই নদের সীমানা নিয়ে জটিলতার কারণে ড্রেজিং বন্ধ করতে হয়।

আত্রাইয়ে আন্তর্জাতিক সমস্যা

আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, আত্রাই নদের খননকাজ বেশ জটিল। কারণ, নদীটি দিনাজপুর জেলার মোহনপুর সেতুর পর আবার ভারতে ঢুকে গেছে। ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরে ৪২ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে সেটি আবার বাংলাদেশে ঢুকেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ওই ৪২ কিলোমিটার নদ খনন করতে ভারতকে অনুরোধ করা হলেও সাড়া মেলেনি। তা ছাড়া আত্রাই নদের দিনাজপুর অংশেও সেতুর উচ্চতা কম হওয়ায় খননকাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। ড্রেজারের যন্ত্রপাতি খুলে সেতুর অপর পাশে গিয়ে আবার সংযোজন করে খনন করতে হচ্ছে। এতে খরচ ও সময় দুটোই বেশি লাগছে।