সাগরে পণ্যবাহী জাহাজ ভাসালেই মিলবে সুবিধা

এবারের বাজেটে পণ্য আনা-নেওয়ার সঙ্গে যুক্ত সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পে বেশ কয়েকটি সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

  • আগাম কর প্রত্যাহার, ভাসানো যাবে ২৫ বছরের পুরোনো জাহাজ।

  • কেনার তিন বছর পর চাইলে বিক্রির সুযোগ।

  • ভাড়ার আয়ের ওপর কর প্রত্যাহার চান উদ্যোক্তারা।

তথ্যসূত্র: নৌ বাণিজ্য অফিসের এপ্রিল মাসের হালনাগাদ তালিকা

সমুদ্রগামী জাহাজের উদ্যোক্তাদের এবারের বাজেট কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে। এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোক্তারা যেসব দাবি জানিয়ে আসছিলেন, তার কয়েকটি পূরণ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

এত দিন এ খাতের উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে সর্বোচ্চ ২২ বছরের পুরোনো জাহাজ আমদানি করতে পারতেন। আবার কেনার পর পাঁচ বছরের আগে ওই জাহাজ বিক্রির কোনো সুযোগ ছিল না। দিতে হতো আগাম করও। তাই করভার তুলে দেওয়াসহ এ খাতের ব্যবসার ওপর আরোপিত বিভিন্ন বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ার দাবি ছিল উদ্যোক্তাদের। এবার তাঁদের কথা শুনেছেন অর্থমন্ত্রী।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তাঁর বাজেট বক্তব্যে সমুদ্রগামী জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট–সংক্রান্ত আদেশে পুরোনো জাহাজের আয়ুষ্কাল ২২ বছরের পরিবর্তে ২৫ বছর এবং আমদানির পর বিক্রয়ের সময়সীমা ৫ বছরের পরিবর্তে ৩ বছর নির্ধারণের সুপারিশ করেন। আবার আগাম কর প্রত্যাহারের প্রজ্ঞাপনে আছে সমুদ্রগামী জাহাজের নামও। প্রজ্ঞাপনে পাঁচ হাজার টনের বেশি পণ্য পরিবহনক্ষমতার সমুদ্রগামী জাহাজ আমদানিতে আগাম কর প্রত্যাহারেরও ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

জানতে চাইলে সমুদ্রগামী জাহাজমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ওশান গোয়িং শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাজেটে সমুদ্রগামী জাহাজে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব দাবি ছিল, তার কিছু পূরণ হয়েছে। এটা ইতিবাচক দিক। তবে এখনো বিদেশি পণ্য পরিবহনে ৫ শতাংশ এবং দেশীয় পণ্য পরিবহনে ৩ শতাংশ কর দিতে হয়। এ কর প্রত্যাহার করা উচিত। কারণ, শুধু বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় আর রপ্তানি আয় নয়, এ খাতে শিক্ষিত লোকের কর্মসংস্থানও হয়।

এমন সময়ে সমুদ্রগামী জাহাজে বিনিয়োগের সুবিধা বাড়ানো হলো, যখন বিশ্বজুড়ে পণ্য পরিবহনের ভাড়া রেকর্ড ছুঁয়েছে। কার্যত মন্দা শেষে গত বছরের শেষ ভাগ থেকে জাহাজ পরিচালনার ব্যবসা চাঙা হয়েছে। তাতে এ খাতের উদ্যোক্তাদের আয় বাড়ছে। পণ্য আমদানির জন্য জাহাজ ভাড়া পেতেও রীতিমতো বেগ পেতে হচ্ছে আমদানিকারকদের।

নৌ–বাণিজ্য কার্যালয়ের গত এপ্রিল মাসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা এখন ৬৬। কেএসআরএম (এসআর শিপিং), মেঘনা গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, কর্ণফুলী লিমিটেড, এমজেএল বাংলাদেশ, ওরিয়ন গ্রুপসহ ১১টি শিল্প গ্রুপের হাতে সমুদ্রগামী জাহাজ রয়েছে। আগের তুলনায় কয়েক বছর ধরে এ খাতের উদ্যোক্তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোয় জাহাজের সংখ্যা বেড়েছে। এ বছর মেঘনা গ্রুপ, কর্ণফুলী লিমিটেডের মতো শিল্পগোষ্ঠী এ খাতে নতুন করে বিনিয়োগ করেছে।

ওশান গোয়িং শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি ও মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হয় এ খাতের উদ্যোক্তাদের। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাহাজ পরিচালনায় যেসব সুযোগ-সুবিধা আছে, সেসব দেশের মতো বাংলাদেশেও এ খাতকে সুবিধা দেওয়া উচিত। তাহলে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে দেশের এ খাত। খাতটির প্রসার হলে যেমন দেশীয় পণ্য পরিবহন বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, তেমনি বিদেশের পণ্য পরিবহন করে রপ্তানি আয়ও বাড়বে। আবার কর্মসংস্থানও বাড়বে।

তিনটি সমুদ্রবন্দরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে সাড়ে ১০ কোটি টনের বেশি আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন হয় সমুদ্রপথে। এ পণ্যের খুব সামান্য অংশই দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজে পরিবহন হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সমুদ্রপথে পণ্য আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ২ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার বা ২৪ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। তবে জাহাজমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ওশান গোয়িং শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে সব মিলিয়ে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন বাবদ ব্যয় আট বিলিয়ন ডলারের কম হবে না। এর মাত্র ৩০০ মিলিয়ন ডলার বা পৌনে ৪ শতাংশ দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের।

বাংলাদেশে নিবন্ধিত সমুদ্রগামী জাহাজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বা প্রায় এক–তৃতীয়াংশের মালিকানা রয়েছে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক কেএসআরএম গ্রুপের হাতে। তাদের হাতে রয়েছে ২৩টি জাহাজ। আকিজ গ্রুপের হাতে রয়েছে ১০টি জাহাজ। এ ছাড়া মেঘনা গ্রুপের রয়েছে নিজস্ব আটটি জাহাজ। এর বাইরে মেঘনা গ্রুপ চারটি জাহাজ ভাড়ায় নিয়ে পরিচালনা করছে। কর্ণফুলী লিমিটেড গত এক বছরে চারটি কনটেইনার পণ্য পরিবহনের ফিডার জাহাজ সাগরে ভাসিয়েছে। বসুন্ধরা গ্রুপের হাতে রয়েছে তিনটি জাহাজ। এর মধ্যে দুটি এলপিজি পরিবহনে ব্যবহার করা হয়। আর এজেএল বাংলাদেশের হাতে রয়েছে তেল পরিবহনকারী দুটি জাহাজ। সিমেন্ট খাতের কোম্পানি এমআই সিমেন্টের হাতে রয়েছে তিনটি জাহাজ। বেসরকারি শিল্প গ্রুপের বাইরে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের হাতে আটটি জাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টিই নতুন।