৫০ কেজি চাল মেলে ২৫ মণ লবণে

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের জোয়ারে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় লবণের মাঠগুলো প্লাবিত হয়েছে। সে জন্য সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় লবণ মৌসুমের।

নৌকা থেকে লবণ গুদামে নিয়ে যাওয়ার কাজ করছেন শ্রমিকেরা। সদরঘাট, চট্টগ্রাম
ছবি: জুয়েল শীল

সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত টানা ছয় মাস লবণের মৌসুম। সেই হিসাবে কক্সবাজার উপকূলের ‘সাদা সোনা’ খ্যাত লবণ উৎপাদনের মৌসুম এমনিতেই শেষ হয়ে আসছিল। এই অবস্থায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে এবারের মৌসুম একটু আগেভাগেই শেষ হয়ে গেল।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার (বিসিক) কক্সবাজার লবণশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপমহাব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল বলেন, ২৩ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলে বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়া শুরু হলে জোয়ারের ধাক্কায় বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এতে লবণের মাঠগুলো প্লাবিত হয়। এর ফলে ওই দিনই আনুষ্ঠানিকভাবে লবণ উৎপাদন মৌসুমের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে।

বিসিকের তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজার জেলার টেকনাফ, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া ও সদর উপজেলায় মোট ৫৪ হাজার ৬৫৪ একর জমিতে লবণ চাষ হয়েছে। এবারে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২২ লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু ২৩ মে পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে ১৬ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের জন্য মহেশখালীতে ৩ হাজার একর লবণ চাষের জমি অধিগ্রহণ হওয়ায় লবণ উৎপাদনে ঘাটতি বেড়েছে।

সরকারি সংস্থাটি জানায়, উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের ৪৪ হাজার প্রান্তিক চাষিসহ লবণ উৎপাদন ও বিপণনে জড়িত রয়েছেন অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ।

■ লক্ষ্যমাত্রা ২২ লাখ ১৭ হাজার মে. টন, উৎপাদন হয়েছে ১৬ লাখ ৫০ হাজার মে. টন। ■ লবণ উৎপাদন ও বিপণনে চাষিসহ জড়িত রয়েছেন পাঁচ লাখ মানুষ। ■ মহেশখালীতে ৩ হাজার একর লবণ চাষের জমি অধিগ্রহণ হওয়ায় লবণ উৎপাদনে ঘাটতি বেড়েছে।

মাটির নিচে ৭ লাখ মেট্রিক টন

কক্সবাজার বিসিকের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে যে ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে, তাতে চাষিদের ২ হাজার ১০০ টন লবণ ভেসে গেছে। চাষিদের হাতে বর্তমানে মজুত আছে ১০ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ। এর মধ্যে ৭ লাখ মেট্রিক টন লবণ মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়েছে। বাকি লবণ খোলা জায়গায় পলিথিনে মুড়িয়ে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। বর্তমানে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকায়।

সম্প্রতি কক্সবাজার শহর থেকে ৮৪ কিলোমিটার দক্ষিণে টেকনাফের উনচিপ্রাং গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে বাড়িতে কালো পলিথিনে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে বিশাল লবণের স্তূপ। সেখান থেকে লবণ ট্রাকে বোঝাই করা হচ্ছে, যা নেওয়া হবে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন কারখানায়।

মোস্তাক আহমদ নামের উনচিপ্রাং গ্রামের এক চাষি জানান, তিনি চলতি মৌসুমে ৩ একর জমিতে লবণ চাষ করেছেন। মাঠ থেকে বাড়িতে স্তূপ করে রাখার পর বৃষ্টিতে ভিজে প্রায় ১৩০ মণ লবণ নষ্ট হয়েছে। প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে তাঁর খরচ হয়েছে ২২১ টাকা। কিন্তু বিক্রি করেছেন ১২০-১৪০ টাকায়। প্রতি মণে তাঁর লোকসান গেছে ৮০-১০০ টাকার মতো।

ফলনে খুশি হলেও দামে ভীষণ হতাশ চাষিরা। কারণ ২৩০ টাকা খরচে উৎপাদিত প্রতি মণ লবণ বিক্রি করতে হচ্ছে ১২০ টাকায়।
ফরিদুল আলম, লবণচাষি, টেকনাফ

টেকনাফ উপজেলা সদরসহ হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও সাবরাং ইউনিয়নে অন্তত আড়াই হাজার একরে কয়েক লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। এখন আড়াই লাখের মতো মাঠে-ময়দানে, সড়কের দুপাশে পড়ে আছে জানিয়ে টেকনাফ লবণ চাষি সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মো. শফিক মিয়া বলেন, ন্যায্যমূল্য না পেয়ে উপজেলায় দুই হাজার প্রান্তিক চাষি হতাশ। সংরক্ষণের গুদাম না থাকায় ৭০ শতাংশ বা ৭ লাখ টন লবণ মাটির নিচে (গর্তে) পুঁতে রাখা হয়েছে। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ লবণ বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য মাটির ওপরে স্তূপ করে পলিথিন মুড়িয়ে রাখা হয়েছে।

চাষিদের লোকসানের কারণ সম্পর্কে শফিক মিয়া বলেন, বিদেশ থেকে শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে আমদানি করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ সোডিয়াম সালফেট লবণ। এটি পরবর্তী সময়ে ভোজ্য লবণ হিসেবে বাজারজাত হচ্ছে। এতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত লবণ বাজারদর হারাচ্ছে। করোনার এই দুঃসময়ে লোকসান দিয়েও মাঠের লবণের ক্রেতা পাচ্ছেন না প্রান্তিক চাষিরা। ১২০ টাকা দরে ২৫ মণ লবণ বিক্রি করে তবেই ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা চাল মিলছে।

টেকনাফের খারাংখালী গ্রামের চাষি ফরিদুল আলম বলেন, চলতি মৌসুমে তেমন ঝড়-বৃষ্টি না হওয়া ও প্রচণ্ড দাবদাহের ফলে লবণের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলনে খুশি হলেও দামে অত্যন্ত হতাশ চাষিরা। কারণ ২৩০ টাকা খরচে উৎপাদিত প্রতি মণ লবণ বিক্রি করতে হচ্ছে ১২০ টাকায়। লকডাউনের সময় গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকায় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে লবণ সরবরাহ করা যায়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

কক্সবাজার সদর, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলায়ও লবণ নিয়ে একই চিত্র দেখা গেছে। চাষিরা উৎপাদিত লবণ মাটির গর্তে পুঁতে রাখছেন। চাষিরা জানান, বর্ষাকালে লবণের দাম বাড়তে পারে। তখন পুঁতে রাখা লবণ বিক্রি করবেন তাঁরা।

আসন্ন বর্ষায় অধিকাংশ লবণের মাঠ আগামী নভেম্বর পর্যন্ত পানিতে ডুবে থাকবে। এ সময় মাঠগুলোতে চলবে চিংড়ি চাষ। চিংড়ি চাষের পর ডিসেম্বরে পুনরায় শুরু হবে লবণের চাষ।