খাতুনগঞ্জে হামিদুল্লাহ মিঞা মার্কেটের কাঁচা পণ্যের পাইকারি আড়ত মেসার্স বাছা মিঞা সওদাগর। সোমবার রাত ১১টার দিকে হু হু করে পানি উঠতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটির গুদামে। প্রতিবছর জোয়ারের পানি ঠেকাতে গুদামের সামনের দরজায় কয়েক ফুট উঁচু দেয়াল দেওয়া হয়েছে। তারপরও সেই উচ্চতা ডিঙিয়ে পানি ঢুকেছে গুদামে।
গুদামে পানি ঢোকার সময় সেখানে ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মোহাম্মদ ইদ্রিস। রাতের অবস্থা বর্ণনা করে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নয়টার পর জোয়ারের পানি বাড়তে থাকে। রাত ১১টার পর হঠাৎ করেই পানির প্রবাহ বেড়ে যায়। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই গুদাম ও প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে যায়। প্রতিষ্ঠানের ১০ জনের মতো কর্মী দ্রুত নিচের দিকের কিছু বস্তা সরিয়ে রাখতে সক্ষম হন। এরপরও ১৫০ বস্তা পেঁয়াজ ও ১৪০ বস্তা হলুদ এবং কিছু আদার বস্তা পানিতে ভিজে গেছে। জোয়ারের পানিতে প্রায় দুই লাখ টাকার কাঁচা পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে।
এবার নিচতলার প্রতিটি দোকান ও গুদামে কমবেশি পানি উঠেছে। তবে কী পরিমাণ পণ্য নষ্ট হয়েছে বা ক্ষয়ক্ষতি কত, তা বের করতে কয়েক দিন সময় লাগবে
প্রায় ৬৭ বছরের পুরোনো পারিবারিক এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ৪২ বছর ধরে ব্যবসা করছেন মোহাম্মদ ইদ্রিস। তবে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর এমন জোয়ার দেখেননি বলে তিনি জানান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘জোয়ারের পানিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমরা। এ কারণে সবাই গুদামে পানি ঢোকার পথ উঁচু করেছে। তাতে জোয়ার হলেও খুব বেশি সমস্যা হয় না অনেক বছর ধরে। এবার কোনোটিই কাজ করেনি। হামিদুল্লাহ মিঞা মার্কেটের সব কটি দোকান ও গুদামে পানি ঢুকেছে।’
এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও গুদামে পানি ঢুকে পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে জোয়ারের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি অন্যবারের তুলনায় বেশি হয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত পানিতে ভিজে যাওয়া পণ্য আলাদা করতে পারেনি অনেকে। এসব পণ্য পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
জোয়ারের পানির উচ্চতা নিয়মিত রেকর্ড করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। অমাবস্যার ভরা জোয়ারের সময় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে জোয়ারের পানির উচ্চতা এবার বেশি ছিল বলে বন্দরের কর্মকর্তারা জানান।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের প্রধান কমান্ডার এম আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, খাতুনগঞ্জের কাছাকাছি স্টেশন হলো সদরঘাট। সোমবার রাত ১১টা ২০ মিনিটে সদরঘাট স্টেশনে জোয়ারের পানির উচ্চতা ছিল ৬ দশমিক ১৪ মিটার। স্বাভাবিক জোয়ারে পানির উচ্চতা থাকার কথা ৪ দশমিক ১৩ মিটার। কিন্তু সোমবার রাতে স্বাভাবিকের চেয়ে জোয়ারের উচ্চতা দুই মিটার বেশি ছিল।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা ভোগ্যপণ্যের বড় অংশ খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বেচাকেনা হয়। খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, আছদগঞ্জসহ এই এলাকাজুড়ে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ভোজ্যতেল, চিনি, গম, চাল, ডাল, মসলা ও কাঁচা পণ্য থেকে শুরু করে রাসায়নিকসহ নানা ধরনের পণ্য বেচাকেনা হয়। চট্টগ্রামের পাশাপাশি সারা দেশে পণ্য সরবরাহ হয় এই বাণিজ্যকেন্দ্র থেকে।
শুধু খাতুনগঞ্জে নয়, চাক্তাই এলাকায়ও গুদামে, প্রতিষ্ঠানে জোয়ারের পানিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। এ রকমই একটি প্রতিষ্ঠান চাক্তাইয়ের ফুলতলি এলাকার ভাই ভাই ডাল মিল। ছোট্ট এই কারখানায় ডাল মাড়াই করে সরবরাহ করা হয়। গতকাল সকালে ভাই ভাই ডাল মিলে গিয়ে দেখা যায়, ভিজে যাওয়া ডালের বস্তা আলাদা করে রাখছেন দোকানের কর্মীরা। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মো. ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, কারখানা ও গুদাম—দুই জায়গাতে জোয়ারের পানি ঢুকে প্রায় ১০ টনের মতো ডাল ভিজে গেছে। এতে কম করে হলেও ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এবারের জলাবদ্ধতায় খাতুনগঞ্জে সব মিলিয়ে ঠিক কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার পরিপূর্ণ হিসাব পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি ও খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এবার নিচতলার প্রতিটি দোকান ও গুদামে কমবেশি পানি উঠেছে। তবে কী পরিমাণ পণ্য নষ্ট হয়েছে বা ক্ষয়ক্ষতি কত, তা বের করতে কয়েক দিন সময় লাগবে।
খাতুনগঞ্জে জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতায় কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, তা নিয়ে ২০২০ সালে চট্টগ্রাম চেম্বারের সহযোগিতায় সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের ন্যাশনাল রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) যৌথ উদ্যোগে একটি গবেষণা হয়। ২০২১ সালে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, অতিবৃষ্টি বা জোয়ারের পানির কারণে জলাবদ্ধতায় দেশের বড় পাইকারি এ বাণিজ্যকেন্দ্রে এক দশকে (২০১১-২০২০) ২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে গবেষণা দলের সদস্য ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক রিয়াজ আকতার মল্লিক গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জোয়ারের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়াসহ নানা কারণে প্রতিবছর এই বাণিজ্যকেন্দ্রে জলাবদ্ধতার পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেওয়া, পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো, চাক্তাই খালসহ আশপাশের খাল সংস্কার, ড্রেনেজ–ব্যবস্থা উন্নত করাসহ সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।