কত বছর ধরে পেঁয়াজ চাষ করছেন? গত মৌসুমে কত জমিতে চাষ করেছেন, মুনাফা কী হয়েছে?
রাজা হোসেন: আমি প্রায় ২৫ বছর ধরে পেঁয়াজ চাষ করছি। গত মৌসুমে চার বিঘা জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ ও চার বিঘা হালি পেঁয়াজ মিলিয়ে মোট আট বিঘায় আবাদ করেছিলাম। গত মৌসুমটা ছিল খারাপ মৌসুমগুলোর একটি। প্রতি মণে উৎপাদন খরচ ছিল প্রায় ১ হাজার ৬০০ টাকা। আর বাজারে বিক্রি করতে হয়েছে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা মণ। তাতে উৎপাদন খরচের অর্ধেক কোনো রকমে উঠেছে। ফলে পুরো মৌসুমে বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হয়েছে।
পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ কতটা বেড়েছে?
রাজা হোসেন: পেঁয়াজের বীজের দাম গত বছরের তুলনায় এবার কিছুটা কম। গত বছর ৭ হাজার টাকা মণ দরে বীজ কিনতে হয়েছে। এবার বীজের দাম ৩ হাজার টাকা। বীজের দাম কমলেও কীটনাশক ও সারের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। গত বছর যে কীটনাশকের দাম ছিল ৬০০ টাকা, এবার তা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার টাকা। সারের দামও একইভাবে বেড়েছে। ডিএপি সার ১ হাজার ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা হয়েছে। টিএসপি সার ১ হাজার ৪৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১ হাজার ৮৫০ টাকা হয়েছে। এই অতিরিক্ত খরচের পরও মৌসুমের শুরুতে কৃষকেরা উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামে পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন। মৌসুমের শেষে দাম কিছুটা বাড়লেও তার সুফল পেয়েছেন মূলত বড় কৃষক ও মজুতদারেরা। কারণ, ছোট কৃষকেরা খুব বেশি দিন পেঁয়াজ ধরে রাখতে পারেন না। তাই পেঁয়াজের দাম এখন বাড়লেও তাতে কৃষকের লাভ খুবই কম।
নতুন পেঁয়াজ ওঠার পরে দাম হঠাৎ পড়ে যায়, আবার শেষ দিকে বাড়ে—প্রতিবছর এই ঘটনা ঘটে। কারণ কী?
রাজা হোসেন: নতুন পেঁয়াজ তুলে আনার সময় প্রান্তিক চাষিরা ঋণ শোধ করতে বা সংসারের খরচ মেটাতে দেদার পেঁয়াজ বিক্রি করেন। এতে বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেড়ে যায়, ফলে দাম পড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, ধরা যাক একজন কৃষকের ২৫ হাজার টাকা দরকার। তিনি যদি প্রতি মণ পেঁয়াজ বিক্রি করে ২ হাজার টাকা পান, তাহলে তাঁকে বিক্রি করতে হবে ১২ থেকে ১৩ মণ পেঁয়াজ। তবে বাজারে যদি দেখা যায় দাম ১ হাজার টাকা, তখন তাঁকে ২৫ মণ পেঁয়াজ বিক্রি করতে হয়। ফলে কৃষকের মজুত কমে যায়। তাই পরে দাম বাড়লে কৃষকের হাতে খুব বেশি পেঁয়াজ থাকে না। সুতরাং পেঁয়াজের দাম শুরুতে পড়ে যাওয়া ও শেষে গিয়ে বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে, কৃষকের ওপর ঋণের চাপ, আর্থিক অস্থিরতা, দীর্ঘদিন সংরক্ষণ–সুবিধার অভাব এবং মৌসুমের শুরুতে বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ।
পেঁয়াজের দাম কারা নির্ধারণ করেন? এ বাজারে কোনো সিন্ডিকেট কাজ করে কি?
রাজা হোসেন: আমাদের এখানে দাম নির্ধারণের কোনো সিন্ডিকেট নেই। কারণ, প্রতিটি হাটে কৃষক সরাসরি এসে পেঁয়াজ বিক্রি করেন। কোনো মধ্যস্বত্বভোগী নেই। ব্যাপারীরা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকেই পেঁয়াজ কেনেন। দাম ওঠানামার কারণ বাজারে সরবরাহ। যেমন—কোনো দিন দাম খুব পড়ে গেলে কৃষকেরা পরের হাটে পেঁয়াজ আনা কমিয়ে দেন, সেই দিনই আবার দাম বাড়ে। সিন্ডিকেট থাকলে তো এমন ওঠানামা হতো না।
কৃষকেরা উৎপাদিত পেঁয়াজ কার কাছে বিক্রি করেন? আগে থেকে কোনো চুক্তি থাকে? আড়তদার বা পাইকারের ভূমিকা কী থাকে?
রাজা হোসেন: কৃষকেরা পেঁয়াজ উৎপাদনের পর বাজারে বিভিন্ন ব্যাপারীর কাছেই সরাসরি বিক্রি করেন। এখানে আগে থেকে কোনো চুক্তিবদ্ধ হওয়ার নিয়ম নেই। এলাকায় কেউ কারও কাছে দাদন নেয়, এমনও নজির তেমন নেই। আর আড়তদার বা পাইকারদের ভূমিকা মূলত বাজারে বিক্রির সুবিধা করে দেওয়া, এর বাইরে দাম নির্ধারণে তাঁদের সরাসরি কোনো হাত নেই।
দেশে কৃষকের জন্য পেঁয়াজ সংরক্ষণ সুবিধা কতটা আছে? কোল্ডস্টোরেজ হলে দাম কি স্থিতিশীল হতো?
রাজা হোসেন: কৃষকেরা শেষ পর্যন্ত পেঁয়াজ ধরে রাখতে পারেন, আর সেটি পারেন শুধু অবস্থাপন্ন কৃষকেরা। প্রান্তিক কৃষকেরা ঋণ, সংসারের খরচ আর নতুন আবাদের ব্যয় মেটাতে আগেভাগেই পণ্যটি বিক্রি করে দেন। এলাকায় কিছু পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার গড়ে উঠেছে। সেখানে পেঁয়াজ রাখলে কিছুদিন ভালো থাকে। সমস্যা হচ্ছে—এসব সংরক্ষণাগার প্রভাবশালীদের বাড়িতে, ফলে প্রকৃত কৃষকেরা এর সুফল কম পাচ্ছেন। পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগার থাকলে কৃষকেরা বেশি পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারতেন। এতে বাজারও স্থিতিশীল থাকত, কৃষকের লাভও বাড়ত।
দেশি পেঁয়াজের ঘাটতি দেখা দিলে আমদানি করতে হয়। দেশের উৎপাদন বাড়াতে ও বাজার স্থিতিশীল রাখতে কী উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন?
রাজা হোসেন: আমাদের দেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ—এটা সত্য। তবে বছরের শেষে সংকট দেখা দিলে ভারতসহ অন্য দেশ থেকে আমদানি করা হয়। আমদানি করা হলে স্থানীয় কৃষকই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। আমার মতে, চারটি উদ্যোগ নিলে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। সেগুলো হচ্ছে—ক) কৃষকের সুবিধার জন্য সার ও কীটনাশকের দাম কমানো। খ) আবহাওয়ার কারণে ক্ষতি হলে কৃষকের জন্য বিশেষ সহায়তা দরকার। গ) স্থানীয় সংরক্ষণাগার বাড়াতে হবে। প্রত্যেক এলাকায় ছোট ছোট গুদাম হলে কৃষক দীর্ঘদিন পেঁয়াজ রাখতে পারবেন। ঘ) অযথা আমদানির সিদ্ধান্ত যেন কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত না করে তার জন্য সঠিক নীতি দরকার। এবার সারা বছর আমদানি তেমন হয়নি, দেশের পেঁয়াজই চাহিদা মিটিয়েছে, এটাই প্রমাণ করে আমরা উৎপাদনে সক্ষম।