খেলাপি বেড়েছে ৯০০০ কোটি টাকা

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে পাওনা ২১ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। 

সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক

অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না।’ অর্থমন্ত্রীর কথা ঠিক থাকেনি। তাঁর ঘোষণার ঠিক আগে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। সাড়ে তিন বছরের মাথায় তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। এ হলো দেশের সার্বিক খেলাপি ঋণের চিত্র।

সার্বিক চিত্র থেকে বেরিয়ে এসে যদি শুধু রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বিডিবিএল ও বেসিক—এই ছয় ব্যাংকের কথা বিবেচনা করা হয়, তাহলে কী চিত্র দেখা যায়? অর্থমন্ত্রী যখন বলেছিলেন আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না, তখন ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৪৬ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা। ২০১৯ সালেই ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সরল সুদে ১০ বছর মেয়াদে ঋণ পরিশোধের সুযোগ করে দিলে পরের বছর ২০২০ সালে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমে আসে ৪৩ হাজার ২৫৫ কোটি টাকায়। তবে পরের বছরেই (২০২১) তা আবার বেড়ে হয় ৫০ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুনে তা আরও বেড়ে ৫৫ হাজার ৪৩০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। অর্থাৎ সাড়ে তিন বছরে ছয় ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়ে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ, খেলাপি ঋণ থেকে নগদ আদায়, অবলোপনকৃত ঋণ, অবলোপন থেকে আদায়, শীর্ষ ২০ খেলাপি ঋণগ্রহীতা থেকে আদায়, ঋণ-আমানত অনুপাত এবং মামলায় আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ নিয়ে ৩ অক্টোবর বৈঠক করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এতে সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরাই (এমডি) উপস্থিত ছিলেন। সার্বিক কৃতিত্বের (পারফরম্যান্স) মূল্যায়ন করে বৈঠকে ব্যাংকগুলোর ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

বৈঠকে উপস্থাপিত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩০ জুন পর্যন্ত ছয় ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকের। এই ব্যাকের মোট ঋণের ২৫ শতাংশই খেলাপি, যার পরিমাণ ১৭ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। আর সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১২ হাজার ১২৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৮ শতাংশ। অন্যদিকে অগ্রণী ব্যাংকের মোট ঋণের ১৭ শতাংশ খেলাপি, যার পরিমাণ ১০ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৭ শতাংশ, পরিমাণ ৬ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। বিডিবিএলের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৩৬ শতাংশ, যার পরিমাণ ৭৬৮ কোটি টাকা। মোট ঋণের মধ্যে খেলাপির হার সবচেয়ে বেশি বেসিক ব্যাংকে। টাকার অঙ্কে যা ৮ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই বিভিন্ন সূচকে ব্যাংকগুলোতে দৃশ্যমান পরিবর্তন। বৈঠকে সে নির্দেশনাই দেওয়া হয়েছে।’

খেলাপি আদায়ে পিছিয়ে জনতা

মোট খেলাপি ঋণের ৬ থেকে ৭ শতাংশ অর্থ আদায় করতে বিডিবিএল ছাড়া পাঁচ ব্যাংকের সঙ্গেই সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকের হলেও খেলাপি গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধারে সবচেয়ে পিছিয়ে এই ব্যাংক। ব্যাংকটি ২০১৯ সালে ৯০৪ কোটি, ২০২০ সালে ১৭৯ কোটি এবং ২০২১ সালে ২৮৩ কোটি টাকা আদায় করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে করা ব্যাংকটির এমওইউ অনুযায়ী, ২০২২ সালে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে ১ হাজার
২৪০ কোটি টাকা। অথচ ছয় মাসে ব্যাংকটি আদায় করতে পেরেছে মাত্র ৮ শতাংশ অর্থাৎ ১০৫ কোটি টাকা।

অন্যদিকে এমওইউ অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংক ১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১৬৫, অগ্রণী ব্যাংক ১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ২৪৮, রূপালী ব্যাংক ৬৭০ কোটি টাকার মধ্যে ১১৭ কোটি, বেসিক ব্যাংক ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার থেকে ১৪৬ এবং বিডিবিএল ৯৮ কোটি টাকার মধ্যে ১৬ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে।

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুছ ছালাম আজাদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘খেলাপি থেকে আদায়ে আমরা বিশেষ মনোযোগ দিয়েছি। আজও (গতকাল) এ ব্যাপারে বৈঠক করে ব্যাংকারদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে নামমাত্র আদায়

গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে পাওনা ২১ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকেরই রয়েছে ৮ হাজার ১০৯ কোটি টাকা।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংককে চলতি বছর শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে ২ হাজার ৪৫ কোটি টাকা আদায় করতে বলেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো গত ৩০ জুন পর্যন্ত আদায় করেছে মাত্র ১১৯ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি আদায় করেছে অগ্রণী ব্যাংক। বেঁধে দেওয়া ৩০০ কোটি থেকে ব্যাংকটি আদায় করেছে ৮৭ কোটি টাকা। আর জনতা ব্যাংক ৮০০ কোটির মধ্যে ১০ কোটি, সোনালী ব্যাংক ৩০০ কোটির মধ্যে মাত্র ৩৮ লাখ, রূপালী ব্যাংক ৩৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ২ কোটি, বিডিবিএল ১০ কোটি টাকার মধ্যে ২ কোটি এবং বেসিক ব্যাংক ৩০০ কোটি টাকার মধ্যে ১৮ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে।

সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থনীতি জানা-বোঝা ও নীতিনিষ্ঠ ব্যক্তিরা ব্যাংকগুলোর পর্ষদে থাকলে সমস্যা সৃষ্টিই হতো কম। অনেক ক্ষেত্রেই এর ঘাটতি দেখা যায়। আবার রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকটা নীরব থাকে। ভাবটা এমন যে আমাদের কী? এ মনোভাব থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বের হয়ে আসা উচিত।’