এখনো নিখোঁজ ব্যবসায়ী মমিনুদ্দিন সুমন, অপেক্ষায় শতাধিক নির্ভরশীল পরিবার

রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় বিআরটিসি বাস কাউন্টারের কাছে সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর যাঁদের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিধ্বস্ত ভবনের নিচতলার ব্যবসায়ী মমিনুদ্দিন সুমন। আনিকা এজেন্সির মালিক সুমনের আরও কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং এসব প্রতিষ্ঠানে সব মিলিয়ে কর্মীর সংখ্যা শতাধিক।

সিদ্দিকবাজারের ভয়াবহ বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১৮। অনেকে আহত হওয়ার পাশাপাশি নিখোঁজও রয়েছেন।

বংশালের বাসিন্দা মমিনুদ্দিন সুমনকে সবাই চেনেন একজন বড় ব্যবসায়ী হিসেবে। ঘটনার এক দিন পর আজ বুধবার স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলো। তাঁরা জানিয়েছেন, আনিকা এজেন্সি ছাড়াও সিদ্দিকবাজারের গলিতে নিউ আনিকা স্যানিটারিসহ মোট চারটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। এ ছাড়া এই স্যানিটারি পণ্যের ব্যবসায়ীর আরও দুটি শোরুম আছে এলিফ্যান্ট রোডে।

এই ছয় প্রতিষ্ঠানে অর্ধশতাধিক লোক কাজ করেন। এই ছয় শোরুম চালাতে তিনি একটি ছোটখাটো কারখানাও গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে ৩০ থেকে ৩৫ জন কর্মচারী আছেন। বংশালে নিজের বাসাসংলগ্ন একটা মোটরসাইকেলের শোরুমেরও মালিক তিনি। সেখানে কাজ করতেন আরও ১০-১৫ জন। সব মিলিয়ে মমিনুদ্দিন সুমনের ওপর নির্ভরশীল শতাধিক পরিবার।

বিধ্বস্ত ভবনের পাশের ফাতেমা মার্কেটের ব্যবসায়ী এ হাই স্যানিটারির মালিক আবদুল আজিজ ওরফে সুমন। নিজেকে মমিনুদ্দিন সুমনের বাল্যবন্ধু বলে পরিচয় দিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিস্ফোরণের কয়েক মিনিট আগেও সুমন আমার দোকানে বসা ছিল। তার দোকানে একজন বড় ক্রেতা আসায় সে চলে যায়।’

আবদুল আজিজ আরও জানান, ‘এরপর আমি আসরের নামাজের জন্য অজু করে আসি। তখন আবার আমার দোকানে একজন ক্রেতা আসেন। শবেবরাতের রাত আসন্ন বলে ওই ক্রেতা আমার কয়েকটি পণ্য নিতে জোরাজোরি করে। এতে আমার আর নামাজে যাওয়া হয়নি। এর মধ্যে আমি ক্যাশ মেমোতে শুধু তারিখটা লিখেছি, সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে।’

পরের পরিস্থিতি আবদুল আজিজ বর্ণনা করেন এভাবে, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম, এটা নাশকতার কোনো ঘটনা হবে। এ জন্য আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার দোকানের কর্মচারীদের নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দোকান বন্ধ করে দিই। এর পরের ঘটনা দেখে তো আমরা হতবাক। বন্ধু চলে গেল। কত বড় ব্যবসায়ী ছিল সে। প্রতিবছর ব্যবসা বাড়াচ্ছিল।

ব্যবসায়ী হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী ছিল সুমন। আমরা ছোটবেলা থেকে বন্ধু। দুজনের নামের শেষে সুমন থাকায় অনেকে ভেবেছে, হয়তো আমিই মারা গেছি। অনেকে আমাকে ফোন করে খোঁজখবর নিচ্ছে।’

আবদুল আজিজ জানান, ২০০০ সালের দিকে মমিনুদ্দিন সুমন সিদ্দিকবাজার এলাকায় ব্যবসা শুরু করেন। তবে তাঁকে তিনি অন্তত ৩৫ বছর ধরে চেনেন। ‘সে চলে গেলে পরিবার তো বটেই, তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শখানেক লোক অভিভাবকহীন হয়ে পড়বে’, বলেন তিনি।

মমিনুদ্দিন সুমনের আরেক বন্ধু বাংলাদেশ পাইপ অ্যান্ড টিউবওয়েল মার্চেন্ডাইজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুহাম্মদ রবিউল হক ওরফে বাদশা মুঠোফোনে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমার বন্ধু মমিনুদ্দিন সুমন ভবনের ভেতরে আটকা থাকতে পারে। আপনারা সবাই মিলে বলেন, আমার বন্ধুকে যেন দ্রুত বের করা হয়। সে বেঁচে আছে কি না, আমরা জানি না। কিন্তু অন্তত তাকে বের করার ব্যবস্থা করেন। আপাতত আমাদের এর বেশি কিছু বলার নেই।’

রবিউল হকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বাদশা ট্রেডিং। এটি মমিনুদ্দিন সুমনের আনিকা এজেন্সির ঠিক লাগোয়া উত্তর পাশেই। ফাতেমা মার্কেটের এই প্রতিষ্ঠানও আনিকা এজেন্সির মতো পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে।

স্থানীয় আরও কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়েছে প্রথম আলোর। তাঁরাও জানেন, বড় ব্যবসায়ী মমিনুদ্দিন কর্মচারীদের আগলে রাখতেন। ঠিক কত টাকার ব্যবসা তাঁর ছিল, সেটা নিশ্চিত করে তাঁরা জানেন না। তবে তাঁদের আন্দাজ, এটা কয়েক কোটি টাকার হবে।

মালিক মমিনুদ্দিন সুমনের খোঁজ এখনো না পাওয়া গেলেও দোকানের কর্মচারী সম্রাটের লাশ গতকাল মঙ্গলবার রাতেই পাওয়া গেছে। মমিনুদ্দিনের আরেক ব্যবসায়ী বন্ধু মো. আরিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতকাল হাসপাতালে খুঁজেছি, খোঁজ পাইনি। নিহত ও আহত—দুই তালিকাই দেখেছি, কোথাও তাঁর নাম নেই। মমিনুদ্দিন হয়তো বেজমেন্টের ভেতরে আটকা আছেন।’

মমিনুদ্দিনের অন্য এক প্রতিষ্ঠানের কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবসাপ্রতিষ্ঠাগুলো একেবারে নিজের মতো করে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। বেশ ভালোও করছিলেন। আমি অন্য একটা দোকানে থাকার ফলে এখনো জানি না, উনি কোথায়।

আমরা তো বটেই, পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন। ওনাকে জীবিত না পাওয়া না গেলে ওনার পরিবার তো ওনাকে হারাবেই, আমরাও অভিভাবকহীন হয়ে পড়ব। কোথায় যাব, কী হবে, তা নিয়ে চিন্তা করছি না। উনি ফিরে আসবেন, সেই প্রত্যাশায় আছি।’

সিদ্দিকবাজারের ভয়াবহ এই বিস্ফোরণে পাশাপাশি থাকা দুটি বহুতল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি ভবন সাততলা, আরেকটি পাঁচতলা। এর মধ্যে সাততলা ভবনটির বেজমেন্ট, প্রথম ও দ্বিতীয় তলা বিধ্বস্ত হয়েছে।