সাক্ষাৎকার: মনিকা পিগনাল বাটা

বাটার জন্য বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ

বাটা শু ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মনিকা পিগনাল বাটা। তাঁর পিতামহ থমাস বাটার হাতেই আন্তর্জাতিক এই জুতার ব্র্যান্ডের পত্তন হয়। বাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠা দিবস উদ্‌যাপনে ২০ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। বাংলাদেশ ভ্রমণ, বাটার ইতিহাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাজিয়া আফরিন।

মনিকা পিগনাল বাটা
প্রশ্ন:

বাংলাদেশে এবারই আপনার প্রথম আসা। কেমন লাগল বাংলাদেশ?

মনিকা পিগনাল বাটা: বাংলাদেশে আসতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক কিছু শুনেছি। বাটা শু অর্গানাইজেশনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ দেশ। এখানে আসতে পারাটা সার্থক হয়েছে। আর যেভাবে আমাকে বরণ করে নেওয়া হয়েছে, সেটা অতুলনীয়।

প্রশ্ন:

বাংলাদেশে আপনার এ ভ্রমণ নিয়ে কিছু বলুন।

মনিকা পিগনাল বাটা: আমরা প্রতিষ্ঠা দিবস উদ্‌যাপন করি ২১ সেপ্টেম্বর, যে দিনটায় আমার দাদা থমাস বাটার হাত ধরে বাটা শু অর্গানাইজেশনের জন্ম হয়েছে। এরপর ছিলেন আমার বাবা, থমাস জন বাটা। এখন আমাদের পরের প্রজন্মে সাত সন্তান আছে। সবাই এ প্রতিষ্ঠানেই কাজ করছেন না। তবে সবাই কোনো না কোনোভাবে এর সঙ্গে জড়িত। প্রতিষ্ঠা দিবস আমরা উদ্‌যাপন করি কর্মীদের সঙ্গে, ক্রেতাদের সঙ্গে, যে অঞ্চলে আমরা কাজ করছি সেখানকার মানুষের সঙ্গে। সঙ্গে আমাদের মূল্যবোধ কিছুটা হলেও জানান দেওয়ার চেষ্টা করি। বাটা পরিবারের মূল্যবোধের জায়গাটা সুদৃঢ়। আমার দাদা প্রতিষ্ঠানটি শুধু মানুষের হাতে জুতা তুলে দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করেননি; বরং চেয়েছেন মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও উন্নত করতে। বাংলাদেশে ৬০ বছর আগে এ প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে। সেই ৬০ বছর আগে আমার দাদা এখানে এসে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছিলেন, কারও কারও জীবনের প্রথম চাকরি দিয়েছিলেন। সেটা অনেকেরই জীবন বদলে দিয়েছিল। আর এখন আমাদের বাটা চিলড্রেনস প্রোগ্রাম এবং কর্মীদের স্বেচ্ছাসেবামূলক উদ্যোগের মাধ্যমে আগের মতোই মানুষের জীবনমান উন্নয়নের প্রচেষ্টা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।

প্রশ্ন:

আপনার বাবার ভিজিটিং কার্ডে সম্ভবত পদবি লেখা ছিল ‘চিফ শু সেলসম্যান’?

মনিকা পিগনাল বাটা: ও হ্যাঁ, ‘সিনিয়র’ শু সেলসম্যান। আপনি ঠিকই বলেছেন, তাঁর ভিজিটিং কার্ডে এটাই লেখা ছিল। তিনি আর কোনো পদবি চাননি কখনো, এমনকি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা অমন কিছুও নয়। তিনি শুধু চাইতেন নিজেই মানুষকে বোঝাতে যে সাধ্যের মধ্যে বাটাই সবচেয়ে ভালো জুতা।

প্রশ্ন:

বাটার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ কী?

মনিকা পিগনাল বাটা: আমাদের কাছে সবকিছুর আগে ক্রেতার স্থান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর চামড়া যখন সহজলভ্য ছিল না, তখন বাটা ক্যানভাসের জুতা বাজারে আনে, যাতে তা জনমানুষের জন্য সহজলভ্য হয়। আমরা সব সময়ই ক্রেতাদের কথা শুনেছি। সব সময়ই ভাবছি, কীভাবে এমন জুতা বানানো যায়, যা ক্রেতাদের পছন্দ হবে আর তা সাধ্যের মধ্যে থাকবে। তাই আমরা আশা করি, মানুষের কাছে বিশ্বস্ত এ ব্র্যান্ড আমাদের নীতি ও মূল্যবোধ, সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধকে সব সময় বহন করবে। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের জুতা হতে হবে দুর্দান্ত।

প্রশ্ন:

বাটার ঐতিহ্য কী বলে মনে করেন?

মনিকা পিগনাল বাটা: আমাদের ঐতিহ্য হলো প্রথম সারির জুতা প্রস্তুতকারী ও কর্তব্যসচেতন প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের সুনামটাই। আমরা কর্মীদের ওপর আস্থা রাখি। কারণ, আমাদের সাফল্য তাদের হাতেই।

প্রশ্ন:

আপনারা এসওএস চিলড্রেনস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কাজ করবেন। বাংলাদেশি শিশুদের জন্য আপনাদের বর্তমান কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

মনিকা পিগনাল বাটা: বাটা চিলড্রেনস প্রোগ্রাম আমাদের কর্মীদের স্বেচ্ছাশ্রমমূলক একটি উদ্যোগ। আমাদের সব কটি প্রতিষ্ঠানে এ উদ্যোগ চলমান। আর আছে আমাদের কর্মীদের নিয়ে গড়া ‘বাটা চিলড্রেনস প্রোগ্রাম কমিটি’। এ কর্মীরা হতে পারেন কারখানার, দোকানের বা কার্যালয়ের। আর তাঁরা নিজেরাই নির্ধারণ করেন যে কেমন স্বেচ্ছাশ্রম দিতে চান। বাংলাদেশে যে কয়টা নতুন উদ্যোগ আমরা শুরু করেছি, তার একটি হলো এই ‘এসওএস চিলড্রেনস ভিলেজেস’-এর সঙ্গে, যেটা নিয়ে আমরা খুবই গর্বিত।

প্রশ্ন:

আপনার মা তো একটি জুতার জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন...

মনিকা পিগনাল বাটা: আমাদের বাটা জুতা জাদুঘর আছে কানাডার টরন্টোতে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় জুতার জাদুঘর এটা। আমাদের কাছে সম্ভবত ৪০ হাজারের বেশি নিদর্শন আছে। একে শুধু জুতার জাদুঘর হিসেবে ধরা হয় না, দেখা হয় সারা বিশ্বের সভ্যতা ও সংস্কৃতির জাদুঘর হিসেবে। আমাদের কাছে মানুষের ব্যবহার করা সবচেয়ে প্রাচীন জুতাও আছে। যেমন আছে মিসরের সম্রাটদের ব্যবহৃত জুতা, চন্দ্রাভিযানে ব্যবহৃত জুতা। যদিও তা প্রথম চন্দ্রাভিযানের নয়। কারণ, নভোচারীরা ফিরে আসার সময় অযাচিত পদার্থ পৃথিবীতে বয়ে আনার আশঙ্কায় সবকিছুই মহাশূন্যে ফেলে এসেছিলেন। আমাদের কাছে আছে অ্যাপোলো-১০ অভিযানের জুতা। আমি নিশ্চিত, খুঁজলে দেখা যাবে বাংলাদেশের কোনো জুতাও আমাদের কাছে আছে। এ জাদুঘর নিয়ে আমরা খুবই গর্বিত। অবশ্যই আমার মা এটা শুরু করেছিলেন। কারণ, মা-বাবার চমৎকার বোঝাপড়া ছিল, যেন এক হাতের দুই আঙুল। তাঁরা সব সময়ই একসঙ্গে ঘুরতে যেতেন আর আমার মা সংগ্রহ করতেন জুতা। এভাবে তিনি হয়ে ওঠেন জুতা আর সারা বিশ্বে জুতার বিবর্তনসংক্রান্ত বিশাল এক জ্ঞানভান্ডার।

প্রশ্ন:

আপনার পরিবারের সব সদস্যই কি এ ব্যবসায় জড়িত?

মনিকা পিগনাল বাটা: আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম এমন পরিবেশে বড় হয়েছি, যেখানে রাতের খাবারের টেবিলে আমরা জুতা নিয়ে আলাপ করতাম। আমার সন্তানেরাও এভাবেই বড় হয়েছে। ছোটবেলায় আমি মা–বাবা-ভাই-বোনের সঙ্গে স্কুল ছুটির দিনগুলোয় অনেক সময়ই কারখানা দেখতে যেতাম। নিজেদের সন্তানদের ক্ষেত্রেও আমরা একই বিষয়গুলো চালিয়ে গিয়েছি। তবে বাটা শু অর্গানাইজেশনে যোগ দেওয়ার জন্য একদমই কোনো চাপ নেই। আমরা শুধু এটুকু নিশ্চিত করতে চেয়েছি, যাতে তারা দায়িত্বশীল মালিক হয়। আমাদের পরিবারের অংশ হওয়া মানে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া, তবে সঙ্গে আছে কর্তব্যও, সেটা হলো দায়িত্বশীল মালিক হওয়া।

প্রশ্ন:

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মনিকা পিগনাল বাটা: আপনাকেও ধন্যবাদ।