বাজারে ‘সিন্ডিকেট’ নিয়ে আপত্তি, আঙুল অব্যবস্থাপনার দিকে

বাজারফাইল ছবি: প্রথম আলো

বাজারে ‘সিন্ডিকেটের’ কারণে অস্থিরতা তৈরি হয়, এই ধারণা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন একদল বিশেষজ্ঞ। তাঁদের দাবি, দাম বাড়লেই বাজারে ‘সিন্ডিকেট’ রয়েছে, এমন ধারণা যথাযথ নয়। বরং বাজারে অব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের ভুল নীতিই অনেকাংশে দায়ী। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবসায়ীদের দায় আছে। কেউ কেউ প্রতিযোগিতা আইনের সমালোচনা করেন। এ আইনে প্রতিযোগিতা কমিশনের করা মামলার রায় নিয়েও প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ। কারও কারও মতে, শুল্কছাড়ের মতো অস্থায়ী নীতির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিকর।

আজ শনিবার রাজধানীতে বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি ফোরাম বা বাংলাদেশ আইপি ফোরাম আয়োজিত ‘দ্রব্যমূল্য, বাজার ব্যবস্থাপনা ও প্রতিযোগিতা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। এতে কোনো কোনো বক্তা ‘সিন্ডিকেট’–এর পরিবর্তে ‘কার্টেল’ (গোষ্ঠী) শব্দটি ব্যবহারের ওপর জোর দেন। দু-একজন প্রচলিত ‘সিন্ডিকেট’ ধারণাকে ভুল আখ্যা দেন এবং কিছু ক্ষেত্রে ‘সিন্ডিকেট’ অর্থনীতির জন্য ভালো বলে মন্তব্য করেন।  

সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিযোগিতা কমিশনের মামলাগুলোর রায়ে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ আইপি ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা হামিদুল মেসবাহ। তিনি বলেন, আইনের মাধ্যমে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানকে ভুলভাবে সাজা দিলে তা বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে, কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। অনেকে উৎপাদনও কমাতে পারেন।  
যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে প্রতিযোগিতা আইনে বিচার হচ্ছে না উল্লেখ করেন হামিদুল মেসবাহ। তিনি বলেন, দেশের কোনো আইনে ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটি লেখা নেই। কিন্তু এর ব্যবহার হচ্ছে। বাজার ব্যবস্থায় যে সিন্ডিকেট আছে বলে মনে করা হয় তা ঠিক নয়। ‘সিন্ডিকেট’–এর পরিবর্তে ‘কার্টেল’ (গোষ্ঠী) শব্দটি ব্যবহার করা উচিত। এ ছাড়া সরকার কোনো পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিতে পারেন না। দাম নির্ধারিত হবে চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে।  

বৈঠকে সাংবাদিকেরা প্রতিযোগিতা কমিশনের কোন মামলার রায় যথাযথ হয়নি, তা জানতে চাইলে হামিদুল মেসবাহ বলেন, ‘প্রায় সব মামলার রায়ে সমস্যা আছে। আমরা বারবার তা ধরিয়ে দিতে চাইলেও কমিশন তা শুনছে না।’ এসব বিষয়ে কথা বললে কমিশনের কোনো অনুষ্ঠানে ডাকা হয় না বলে মন্তব্য করেন তিনি।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক মো. হেলালুদ্দিন বলেন, শুল্ক কমানোর মতো অস্থায়ী নীতি বাজারের ক্ষতি করে। বাজারে আগুন লাগার (মূল্যবৃদ্ধি) পরে যখন তা নেভাতে যাওয়া হয়, তখন চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য থাকে না। বাজার যেন উত্তপ্ত হতে না পারে সে জন্য আগেভাগে পদক্ষেপ নিতে হবে। আর চাল ও পেঁয়াজের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক একেবারে না থাকাই ভালো বলে মনে করেন তিনি।

দাম বাড়লেই সেটিকে ’সিন্ডিকেট’ বলা উচিত নয় উল্লেখ করে হেলালউদ্দিন বলেন, এর সঙ্গে আরও অনেক কারণ দায়ী থাকতে পারে। মূল্যস্তর বৃদ্ধির জন্য সরকারের অকার্যকর নীতির দায়ও কম নয়। এ ছাড়া একটি দেশে কোন খাতে কতটা কোম্পানি থাকবে তা আলাদাভাবে লেখা থাকে না। এটা চাহিদার ওপর নির্ভর করে। ওই খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। তাই দাম বাড়লেই গণমাধ্যম ঢালাওভাবে সিন্ডিকেট বলা থেকে বিরত থাকলে তা বাজারের জন্য ভালো।

এদিকে বাজারে সিন্ডিকেট নেই, এমন বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি বলেন, প্রকৃত কৃষক মাঠেই ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কোম্পানিগুলো ভেজাল সুগন্ধি চাল বাজারজাত করছে, যার কোনো ব্যাখ্যা নেই, জবাবদিহিও নেই। এসব নিয়ে কেউ ভাবছে না। এ জন্য তিনি সিন্ডিকেটের মতো শব্দের ব্যাখ্যায় আটকে না থেকে বাজারের প্রকৃত সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান।

ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য ও অর্থনীতি অনুষদের ডিন এ কে এনামুল হক মনে করেন, বাজারের অস্থিরতা অল্প সময়ে দমন করতে গেলে বাজার আরও বেশি অস্থির হবে। সব দেশের প্রতিযোগিতা কমিশনকে কোম্পানিগুলো ভয় পায়। আমেরিকায় মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানও সে দেশের প্রতিযোগিতা কমিশনকে ভয় পায়। বাজার ঠিক করতে গেলে দুর্নীতি কমাতে ও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অন্যথায় ভালো উৎপাদন প্রতিষ্ঠান বাজার থেকে সরে যাবে। তবে এটা ঠিক যে বাজার শুধু সিন্ডিকেটের কারণেই অস্থিতিশীল হয় না। নানা কারণে অস্থিতিশীল হয়।  

কিছু ক্ষেত্রে ‘সিন্ডিকেট’ ক্ষতির পরিবর্তে ভালো ফল বয়ে আনে বলে মন্তব্য করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাসনুভা শেলি। তিনি বলেন, সব ‘সিন্ডিকেট’ খারাপ না। কিছু কিছু ‘সিন্ডিকেট’ ভালো। মাঝেমধ্যে সংবাদপত্রের নানা খবরও বাজারে প্যানিক (আতঙ্ক) তৈরিতে ভূমিকা রাখে। প্রতিযোগিতা আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি ডেটা সেন্টার তৈরি করে বাজারের তথ্য সংরক্ষণের দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সাবেক পরিচালক খালিদ আবু নাসের বলেন, বাজার কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। যে কারণে সিন্ডিকেটের একটা সম্ভাবনা সব সময় থাকে। তবে এখন বাজারে অস্থিরতার জন্য ডলারের উচ্চ বিনিময় হারের মতো বিষয়ও ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া সাধারণ বাজার ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়ে ভাবার সময় এসেছে বলে মনে করেন তিনি।

এই অনুষ্ঠানে অবশ্য বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) মতো বাজার–সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কোনো প্রতিনিধিকে দেখা যায়নি। এ নিয়ে আয়োজকদের পক্ষ থেকে অবশ্য সব পক্ষকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল বলে জানানো হয়।

বাংলাদেশ আইপি ফোরামের প্রধান নির্বাহী ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মনজুরুর রহমানে গোলটেবিল আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন।