বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে: মসিউর রহমান

প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান মনে করেন, পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। তবে এই দ্বন্দ্বে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে জানান। মূলত বিএসইসির একজন কমিশনারের বক্তব্যের সূত্র ধরে আজ বুধবার তিনি এসব কথা বলেন।

রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন মসিউর রহমান। বণিক বার্তা ও বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিএলএফসিএ) যৌথ আয়োজনে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) সংযোগ অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে এই সেমিনারের আয়োজন করা হয়।

বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয় উল্লেখ করে মসিউর রহমান বলেন, ‘যেভাবেই হোক, এ বিষয়ে আমি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতি সহানুভূতিশীল। যে বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য হয়, তা হলো “ব্যাংকের লোকসান মেটানোর আগে” ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশ দেওয়া হবে কি না। এমন একটি বিষয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য আগে থেকে ছিল। তবে বিষয়টির সর্বশেষ কী হয়েছে, তা আমার জানা নেই।’

এ ছাড়া সুশাসনের বিষয়ে বিএসইসির নীতিমালা অনেক শক্ত থাকলেও তা অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর হয়নি বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা।

মসিউর রহমান আরও বলেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য শিল্পের উৎপাদনশীলতার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কারণ, এখন আমাদের নিজেদের বাজার ও রপ্তানি বাজার দুই বাজারেই প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে। বাজার ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে প্রতিযোগিতা কমিশনকে এখন আরও সক্রিয় করতে হবে। প্রতিষ্ঠানটি এখন নামে মাত্র আছে। এ ছাড়া এনবিএফআই নিয়ে প্রস্তাবিত আইনের খসড়াটি পড়ে আছে। এটা যাতে দ্রুত আলোর মুখ দেখে, সে জন্য অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আনতে হবে।’

এর আগে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএসইসির কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, ‘অনেক এনবিএফআইয়ের টেকসই পরিচালন ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এর মধ্যে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত। আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় বেশ কিছু সমস্যা আছে। অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন ধারা আছে। যখন কোনো নীতিতে ভিন্নতা দেখা দেয়, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক তাদেরটা ঠিক হিসেবে বিবেচনা করে। তাদেরটা কার্যকর হিসেবে মানে। বিএসইসির নীতি মানা হয় না।’

মিজানুর রহমান আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের আর্থিক উন্নয়ন হয়েছে ব্যাংককেন্দ্রিক। এনবিএফআইগুলো সেভাবে আগাতে পারেনি। এটা গভীরভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আমরা আশা করি, সরকার বিষয়গুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে। কারণ, দিন শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকা নির্ভর করে তাদের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার গুণগত মানের ওপর।’ এ ব্যাপারে বিএসইসি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যৌথভাবে কাজ করার সুযোগ আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘এসএমই উদ্যোক্তারা ঋণের মাত্র ৩৩ শতাংশ পান ব্যাংক আর এনবিএফআই থেকে। বাকি ঋণ তারা অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে সংগ্রহ করে। আনুষ্ঠানিক খাত থেকে ঋণ নেওয়ার শর্ত সহজ করতে হবে। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো দেশ—যাদের অর্থনীতি আমাদের চেয়ে খারাপ, তাদেরও এসএমই খাতে প্রবৃদ্ধি ভালো। সেই তুলনায় আমরা পিছিয়ে আছি। দেশের তৈরি পোশাকের মতো শ্রম নিবিড় খাতে কর্মসংস্থানের হার কমছে। কারণ, প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। তাই সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য এসএমইর মতো খাতকে গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই।’

অনুষ্ঠানে বিএলএফসিএর চেয়ারম্যান মো. গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া বলেন, করোনা–পরবর্তী সময়ে কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছে। তবে যেখানে ব্যাংকের সেবা পৌঁছায়নি, সেখানে এনবিএফআই পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে। এ খাতে যারা অনিয়মে জড়িত, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ঋণের প্রায় ২৫ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে, এটার প্রতিকার প্রয়োজন। খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের চিহ্নিত করে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।

যেসব প্রতিষ্ঠান সমস্যায় পড়েছে, তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরামর্শ দেন।

এর আগে দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, শিল্পোন্নয়নে এনবিএফআইয়ের ভূমিকা অনেক বেশি। মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়ার ফলে ব্যবসায়ীরা অনেক বেশি উপকৃত হচ্ছেন। এনবিএফআইগুলোকে মানুষের আস্থা অর্জন করে উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য কাজ করে যেতে হবে। এখানে যাঁরা ফটকা ব্যবসায়ী রয়েছেন, তাঁদের বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বানও জানান তিনি।

তৃতীয়বারের মতো আয়োজিত এই এনবিএফআই সংযোগ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আইডিএলসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামাল উদ্দিন, আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিনুল ইসলাম, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কায়সার হামিদ, অ্যালায়েন্স ফাইন্যান্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কান্তি কুমার সাহা, লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা শাহরিয়ার, ডিবিএইচ ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিমুল বাতেন, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামসুল ইসলাম প্রমুখ।