অনেক বড় প্রকল্প বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে: আনু মুহাম্মদ
সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ভূমিকা পালনের কথা এবং পুরো আর্থিক খাতে তার যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, তার কিছুই কাজ করছে না।
পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, আদালত ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানও সামগ্রিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণ ও বিশেষজ্ঞদের মতের কোনো প্রতিফলন নেই। মানুষ যে মত দিচ্ছে আর সিদ্ধান্ত যা নেওয়া হচ্ছে, একটার সঙ্গে আরেকটার কোনো মিল নেই।
আজ শনিবার ‘অর্থনীতি: নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে আনু মুহাম্মদ এসব কথা বলেন। প্রথম আলো নিজস্ব কার্যালয়ে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেনের সঞ্চালনায় এতে দেশের বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও ব্যবসায়ী নেতারা অংশ নেন।
আনু মুহাম্মদ বলেন, তিনটা সমস্যা এখানে প্রকট। প্রথমত, স্বচ্ছতার সমস্যা, দ্বিতীয়ত জবাবদিহির সমস্যা ও তৃতীয়ত, প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা। দেশে একেকটা সিদ্ধান্ত হচ্ছে, নীতিমালা তৈরি হচ্ছে, কে তৈরি করছেন, কীভাবে তৈরি হচ্ছে, কার স্বার্থে হচ্ছে—এসব বিষয়ে কোনো স্বচ্ছতা নেই। এগুলো যেন অনেকটা ট্রাফিক সিগন্যাল পদ্ধতির মতো—বাতি যখন সবুজ থাকে, তখন গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। আর যখন লাল থাকে, তখন গাড়ি চলে।
অনেক বেশি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ এমনকি সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকেরাও আপত্তি জানিয়েছিলেন উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, তারপরও লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এরপর ব্যাংক খাত চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তগুলো যতটা না সামনে থেকে নেওয়া হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি নেওয়া হচ্ছে পেছন থেকে। হোটেলে বসেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থে এসব হচ্ছে। ওই সব গোষ্ঠী কর সুবিধা পাচ্ছে, অর্থ পাচারের সুবিধাও পাচ্ছে।
বেসরকারি খাতের বড় ব্যবসায়ী প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবেও নিয়োগ পেয়েছেন, এমন মন্তব্য করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপের বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার নিয়ে ডেইলি স্টারে একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। সরকারের আচরণটা এমন যে মনে হয় এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। অথচ সরকারের দিক থেকেই যথাযথ তদন্ত করা উচিত ছিল। একটা পত্রিকা ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও সরকারের দিক থেকে কোনো সাড়া (রেসপন্স) নেই।
আনু মুহাম্মদের মতে, বর্তমান সময়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার পেছনে অন্যতম কারণ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত। তিনি বলেন, আইন করে ২০১০ সালে জবাবদিহি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, যা কিছুই করা হোক না, তা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না, আদালতেও যাওয়া যাবে না। অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের বদলে স্বল্প খরচের বিকল্প প্রস্তাব সরকারকে তখনই দেওয়া হয়েছিল। সরকার তা আমলে নেয়নি। এ ছাড়া যেসব চুক্তি করা হচ্ছে, তা নিয়ে কারও প্রশ্ন নেই। গ্যাসকূপ খননের যে সক্ষমতা আছে, সে ব্যাপারে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ গ্রহণ না করে একের পর এক সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
এখন যে গ্যাসের সংকট, এরও সুবিধাভোগী গোষ্ঠী আছে বলে মনে করেন আনু মুহাম্মদ। বলেন, বিচারব্যবস্থায় যেমন অপরাধের সুবিধাভোগীকে খোঁজা হয়, গ্যাসের ক্ষেত্রে তেমন সুবিধাভোগী আছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী তো বহু আগেই বলেছেন, ‘আমাদের এলপিজিতে (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) যেতে হবে। এলপিজির সঙ্গে যুক্ত ক্ষমতাবান ব্যবসায়ীরা। আর এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির দিকে সরকার গেল, এর দাম যে এত বেড়ে যাবে, সরকারের একটা অনুমান থাকবে না? আমদানিনির্ভর ও ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলোর দিকে বাংলাদেশ মনোযোগ দিয়েছে। অনেক বড় প্রকল্প বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে। একটা বিপর্যয় আর্থিক দিক থেকে, আরেকটা পরিবেশগত। কত দিন পর্যন্ত এ ভার যে জনগণকে বইতে হবে, আমরা জানি না।’
আনু মুহাম্মদের প্রশ্ন, এ পরিস্থিতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে, জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারে বাড়লে দেশেও বাড়ছে, কিন্তু বিশ্ববাজারে কমলে দেশে আর কমছে না কেন? তিনি বলেন, এসব পরিস্থিতি নিয়েই সম্প্রতি নতুন মন্ত্রিসভা হলো। তাদের মাধ্যমে যে নীতি পদক্ষেপে কোনো পরিবর্তন আসবে, তা বলা কঠিন। উদাহরণস্বরূপ যদি বলা হয়, দেশে একটা পাওয়ার পলিসি হয়েছে এবং তা করেছে জাইকা (জাপান আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা)। এখানে দেশীয় কোনো লোক ছিল না। জাইকা যেসব প্রকল্পের পরামর্শ দিয়েছে, সব কটিতে তাদের স্বার্থ আছে। ২০১৬ সালের পলিসি সংশোধন হচ্ছে, কিন্তু কোনো পরিবর্তনের আশা করা যাচ্ছে না।
আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আমরা অনেক সময় বলি অমুক মন্ত্রী ভালো, অমুক মন্ত্রী দুর্নীতিবাজ। এসব বলে কোনো লাভ নেই। আসলে শাসনব্যবস্থাটাই এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে এবং সবকিছু এত বেশি এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেছে যে সরকারের কোনো মন্ত্রণালয় যে কাজ করছে, তার কোনো প্রতিফলন নেই। ফলে মন্ত্রী দিয়ে এখানে কিছু হচ্ছে না। যে ধারাবাহিকতায় আজ সংকট তৈরি হয়েছে, তা দূর হওয়ার আপাতত কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। সরকারের কাছে চ্যালেঞ্জ কী জানি না। তবে লক্ষণ দেখে মনে হয়, সরকারের কাছে একটাই চ্যালেঞ্জ চিরস্থায়ী ক্ষমতায় থাকা। জনগণের জন্য চ্যালেঞ্জ যেগুলো, সেগুলো সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে গণ্য করছে না।’