বিদেশি ঋণ পরিশোধ ৪৫ শতাংশ বেড়েছে, দ্বিগুণ হয়েছে সুদ পরিশোধ

ঋণপ্রতীকী ছবি

বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশকে এখন তুলনামূলকভাবে বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি সময়ে) আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুদ পরিশোধ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।

দেশের বৈদেশিক ঋণের হালনাগাদ পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তৈরি করা সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।

গত সাত মাসে পরিশোধ করা ঋণের আসল ছিল ১০৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ কোটি ডলার বেশি।

বিদেশি ঋণ পরিশোধের এই চাপ এসেছে এমন এক সময়ে, যখন দেশে দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ডলার-সংকটের এই সময়ে বিদেশি ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কারণে রিজার্ভ ও বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, চীন ও রাশিয়ার স্বল্প মেয়াদের ঋণের কারণে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। ইতিমধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের ঋণ পরিশোধও শিগগির শুরু হবে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এখন অবধারিতভাবে এগুলোর জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধের চাপ এসেছে।

ইআরডির তথ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের প্রায় ১৮৫ কোটি ৬৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১২৮ কোটি ৪৭ লাখ ৮০ হাজার ডলার। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৫৭ কোটি ২০ লাখ ডলার।

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের বিদেশি ঋণের অর্থ ছাড়ও কিছুটা বেড়েছে। গত জুলাই-জানুয়ারি সময়ে উন্নয়ন–সহযোগীরা সব মিলিয়ে ৪৪০ কোটি ডলার ঋণ ছাড় করেছে। শুধু জানুয়ারি মাসে ছাড় হয়েছে ৩৪ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ঋণ ছাড়ের মোট পরিমাণ ছিল ৪২৬ কোটি ডলার।

তবে অর্থনীতিবিদদের যে বিষয়টি বেশি উদ্বিগ্ন করছে, তা হলো ঋণের সুদ পরিশোধ দ্বিগুণ হওয়া। জুলাই থেকে জানুয়ারি—এই সাত মাস সময়ে ৭৬ কোটি ডলার ব্যয় করতে হয়েছে কেবল বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ। আগের বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল সাড়ে ৩৬ কোটি ডলার। অন্যদিকে গত সাত মাসে পরিশোধ করা ঋণের আসল ছিল ১০৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ কোটি ডলার বেশি।

ডলারের বাড়তি দামের কারণে টাকার অঙ্কের হিসাবেও ঋণ পরিশোধ অনেক বেড়ে গেছে। গত জুলাই-জানুয়ারি সময়ে সব মিলিয়ে ২০ হাজার ৪১৮ কোটি টাকার বিদেশি ঋণ পরিশোধ হয়েছে। গত বছর একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা।

কেন ঋণ পরিশোধ বাড়ল, এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইআরডির একাধিক কর্মকর্তা জানান, চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে। এসব ঋণের গ্রেস পিরিয়ড কম, তাই ঋণ পাওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়। ইতিমধ্যে মেট্রোরেল ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। এই দুটি প্রকল্পের জন্য বছরে দুবার করে কিস্তি দিতে হয়।

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানের মতে, ভবিষ্যতে ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে। তখন তা পরিশোধের সক্ষমতা আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ডলারে ঋণ নিয়েছি, শোধও করতে হবে ডলারে। কিন্তু ডলার পাওয়ার অন্যতম প্রধান উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয় প্রবাহের ধারাবাহিকতা নেই। পরিস্থিতি কখনো একটু ভালো, আবার কখনো খারাপ।’

সেলিম রায়হান আরও বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এই প্রকল্পগুলো যদি রপ্তানি বাড়ানো এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টে ভূমিকা রাখতে না পারে, তাহলে এগুলো বিদেশি মুদ্রা অর্জনে তেমন কাজে আসবে না।

কে কত দিল

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের বিদেশি ঋণের অর্থ ছাড়ও কিছুটা বেড়েছে। গত জুলাই-জানুয়ারি সময়ে উন্নয়ন–সহযোগীরা সব মিলিয়ে ৪৪০ কোটি ডলার ঋণ ছাড় করেছে। শুধু জানুয়ারি মাসে ছাড় হয়েছে ৩৪ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ঋণ ছাড়ের মোট পরিমাণ ছিল ৪২৬ কোটি ডলার।

অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে বরাবরের মতো এগিয়ে আছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এই সংস্থা গত সাত মাসে ছাড় করেছে ১২৪ কোটি ডলার। এরপর রয়েছে জাপান। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান এই উন্নয়ন–সহযোগী দিয়েছে ৮৮ কোটি ডলার। তৃতীয় স্থানে থাকা বিশ্বব্যাংক ছাড় করেছে ৭৬ কোটি ডলার। চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে আছে যথাক্রমে রাশিয়া (৫৯ কোটি ডলার) ও চীন (৩৬ কোটি ডলার)।

তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে চার গুণের বেশি। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে উন্নয়ন–সহযোগীরা ৭১৭ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ঋণ ও অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আগের বছর একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ১৭৬ কোটি ডলার।