দাম বেঁধে আলু–ডিম–পেঁয়াজের বাজারে লাগাম টানার চেষ্টা, কতটা সফল হবে

সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসকেরা বাজার তদারক করবেন বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী।

বাজারে বাড়তে থাকা দামের লাগাম টানতে নতুন করে তিনটি পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বেঁধে দিয়েছে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার পেঁয়াজ, আলু ও ডিম—এই তিন পণ্যের দাম ঠিক করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বেশ কিছুদিন ধরে এই তিন পণ্যের দামে বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে।

যদিও আগে কয়েক দফায় ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বেঁধে দিয়ে তা কার্যকর করতে পারেনি সরকার। তবে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, কীভাবে নতুন দাম কার্যকর করা হবে, তার কোনো কৌশল সরকারের নেই। সরকার বলছে, বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকর করতে নিয়মিত বাজার তদারকি করা হবে। নতুন দাম ঘোষণার পর গতকাল বিকেলে তা সব জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

কেবল তো ঘোষণা হলো। প্রচার হতে একটু সময় লাগবে। আশা করছি দু-এক দিনের মধ্যেই তা কার্যকর হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আজ (গতকাল) থেকেই মাঠে নামবে।
টিপু মুনশি, বাণিজ্যমন্ত্রী

সচিবালয়ে গতকাল ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের উৎপাদন, চাহিদা ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি তিন পণ্যের বেঁধে দেওয়া দাম ঘোষণা করেন। এখন থেকে খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম হবে সর্বোচ্চ ১২ টাকা, প্রতি কেজি আলু ৩৬ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজ ৬৫ টাকা।

এ বৈঠকে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ, কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তার, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘কোনো কারণ ছাড়াই বাজারে অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যও রয়েছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন ন্যায্য দাম কার্যকর করব।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তিন পণ্যের যে দাম ঘোষণা করেছে, তা কৃষি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করেই নির্ধারণ করা হয়েছে বলেন জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। কৃষি বিপণন আইন, ২০১৮–এর ক্ষমতাবলে দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এত দিন আমরা কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিইনি। আজই (বৃহস্পতিবার) প্রথম তা করে দিলাম। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই তা করা হয়েছে। আশা করছি এটা বাস্তবায়ন করতে পারব।’

সরকার এর আগে ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু বেঁধে দেওয়া সেই দাম কার্যকর করতে পারেনি। এই ব্যর্থতার জন্য বেশ অনেকবারই বাজার সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন

হিমাগারে (কোল্ডস্টোরেজ) রাখা, পরিবহনসহ সব খরচের হিসাব করে আলুর দাম ৩৫ থেকে ৩৬ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয় বলে জানান টিপু মুনশি। তবে ঢাকায় যদি এ দাম হয়, তাহলে চট্টগ্রামে একটু বাড়তে পারে। তবে হিমাগারের গেটে আলুর দাম হবে ২৬ থেকে ২৭ টাকা কেজি। খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজের যৌক্তিক সর্বোচ্চ মূল্য প্রতি কেজি ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা হওয়া উচিত বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, স্থানভেদে এক টাকা ব্যবধান হতে পারে। পেঁয়াজের পাইকারি দাম হবে ৫৩ থেকে ৫৪ টাকা কেজি।

ডিমের খুচরা মূল্য ১২ টাকা নির্ধারণ করে বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ৫০ পয়সা। দামের ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশেও খবর নেওয়া হয়েছে। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, দাম না কমলে ডিম আমদানি করা হবে।

সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে দরকার হচ্ছে নজরদারি বৃদ্ধি এবং সরবরাহব্যবস্থা ঠিক রাখা। নইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে অভিযান চালানোর অর্থ হবে ক্ষতস্থানে মলম লাগানোর মতো, যাতে মূল রোগ সারবে না।
গোলাম রহমান, সভাপতি, ক্যাব

নির্দিষ্ট করে ডিমের যে দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বাংলাদেশ এগ প্রোডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তাহের আহমেদ সিদ্দিকী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো পণ্যের দাম বেঁধে দিলেই সেটা কমে আসবে বলেও মনে হয় না।’ 

সরকার এর আগে ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু বেঁধে দেওয়া সেই দাম কার্যকর করতে পারেনি। এই ব্যর্থতার জন্য বেশ অনেকবারই বাজার সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়েছিল। এবার অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আলু কৃষকের ঘরে নেই। হিমাগারে চলে গেছে। সেখানে ২৭ টাকার বেশি দরে বিক্রি করতে দেব না। যদি তারা সে দামে বিক্রি না করে আটকে রাখে, তাহলে সেখান থেকে বের করে নির্ধারিত দামে বিক্রি করা হবে। প্রয়োজনে নিলাম করে দেব, যাতে ২৭ টাকা দাম থাকে।’

আরও পড়ুন

সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে শক্তি দেখাবে সরকার

শুধু দাম বেঁধে দেওয়া নয়, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসকেরা বাজার তদারক করবেন বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, এ তদারকি চলবে জেলা-উপজেলাসহ বড় বড় শহরে। সর্বাত্মক শক্তি নিয়ে বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হবে।

দাম কার্যকরের সময় সম্পর্কে জানতে চাইলে টিপু মুনশি বলেন, ‘কেবল তো ঘোষণা হলো। প্রচার হতে একটু সময় লাগবে। আশা করছি দু-এক দিনের মধ্যেই তা কার্যকর হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আজ (গতকাল) থেকেই মাঠে নামবে।’

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান মনে করেন, সরকারের উদ্দেশ্য হয়তো মহৎ, তবে বাস্তবায়ন পদ্ধতি বাস্তবসম্মত নয়। সেলিম রায়হানের প্রশ্ন, এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নিশ্চয়তা কোথায় যে ব্যবসায়ীরা সরবরাহ পরিস্থিতি ঠিক রাখবেন? পণ্য যে হঠাৎ উধাও হয়ে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? স্থানীয় ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থাপনা বলতে কি কিছু আছে?

আরও পড়ুন

সয়াবিন তেলের দাম কমল

এদিকে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফলে বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম হবে ১৬৯ টাকা। পাশাপাশি লিটারে খোলা পাম তেলের দামও ৪ টাকা কমিয়ে ১২৪ টাকা করা হয়েছে।

আগামী রোববার থেকে এই দাম কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। বোতলজাত ৫ লিটার সয়াবিনের দামও কমেছে একই হারে। ৮৫০ টাকার পরিবর্তে ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হবে ৮২৫ টাকায়।

আরও পড়ুন

গতকালের বাজারচিত্র

রাজধানীর মগবাজার, মালিবাগ ও রামপুরা বাজারে গতকাল প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল ৫০ টাকার আশপাশে। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৮৫ থেকে ৯০ টাকা, আর আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ছিল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। বাদামি রঙের ডিমের ডজন ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা। আর সাদা রঙের ডিমের ডজন ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা।

প্রতিটি ডিমের দাম ১২ টাকা বেঁধে দেওয়ার বিষয়ে মালিবাগ বাজারের ডিম বিক্রেতা আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে দাম বেঁধে না দিয়ে যেসব বাজার ও জায়গা থেকে ডিম আসে, সেখানে তদারকি বাড়াতে হবে। কত টাকায় ডিম উৎপাদিত হচ্ছে, তার খোঁজ নিতে হবে। অন্যথায় খুচরা দাম বেঁধে দিয়ে লাভ হবে না। কারণ, আমরা সামান্য লাভে ডিম বিক্রি করি।’

রামপুরা বাজারের মহিউদ্দিন এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা আল-আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার এর আগেও চিনির মতো পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছিল, কিন্তু কার্যকর করতে পারেনি। পণ্যের দাম বেশি থাকলে বেচাকেনা কমে যায়, আমাদের লাভও কম হয়। পণ্যের দাম কম থাকলে ব্যবসা ভালো হয়।’

আরও পড়ুন

জোর দিতে হবে সরবরাহব্যবস্থায়

বাজারে যে সব জিনিসের দাম বাড়তি, সরকারি হিসাবই তা বলে দিচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১১ বছর ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ, ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রধান নায়ক হিসেবে মুরগি ও ডিমের কথা উল্লেখ করেছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেছিলেন, এ দুটি পণ্যের দাম ব্যাপক বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতির হিসাবে।

তিন পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। হয়তো বাংলাদেশ ব্যাংকের সে স্বাধীনতা নেই। তাই এদিক-ওদিক করে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তিনটি পণ্য অতিপ্রয়োজনীয় বলে সরকার দাম ঠিক করে দিয়েছে—এ খবরকে এক ধরনের সাধুবাদ জানাই।’

গোলাম রহমান বলেন, তবে মুক্তবাজার ব্যবস্থায় তা কার্যকর করা সহজ হবে না। আর হুমকি যত কম দেওয়া যায়, ততই ভালো। সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে দরকার হচ্ছে নজরদারি বৃদ্ধি এবং সরবরাহব্যবস্থা ঠিক রাখা। নইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে অভিযান চালানোর অর্থ হবে ক্ষতস্থানে মলম লাগানোর মতো, যাতে মূল রোগ সারবে না।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন