দাম বেশি বাজারে, আয় বেশি সরকারের

দেশে চিনি আমদানির বিপরীতে সরকার গত বছর প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পেয়েছে, যা পরোক্ষভাবে ভোক্তাদের পকেট থেকেই গেছে।

বাজার থেকে এক কেজি চিনি কিনতে এখন ক্রেতাদের খরচ হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা। এই টাকা থেকে পরোক্ষভাবে সরকার পাচ্ছে প্রায় ২৯ টাকা, যা চিনির কাঁচামাল আমদানির সময় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেটে নেওয়া হয়।

চিনির আমদানিমূল্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের রাজস্ব আয়ও সমানতালে বাড়ছে। তবে চিনির মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপাকে পড়েন ক্রেতারা। বাজারে গিয়ে হিমশিম খান তাঁরা। এদিকে রোজাও ঘনিয়ে আসছে। এর আগেই চিনির দাম অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি হয়ে আছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যগুলোর মধ্যে গম ও ডাল আমদানিতে শুল্ক-কর নেই। তবে চাল, চিনি ও তেল আমদানিতে শুল্ক-কর দিতে হয়। গত বছর বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় দেশেও দাম বাড়ছিল এসব পণ্যের। সে জন্য ক্রেতাদের স্বস্তি দিতে গত বছর রোজার আগে সয়াবিন ও পাম তেলে শুল্ককর তিন দফা কমানো হয়। চালেও কমানো হয় শুল্কহার। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে চিনির দাম দ্বিগুণ হলেও ক্রেতাদের স্বস্তি দিতে পণ্যটির ওপর থেকে করভার কমানো হয়নি।

দেশীয় চিনিশিল্পের সুরক্ষায় সরকার চিনিতে করভার আরোপ করেছিল। তবে দেশে চিনি উৎপাদন হয় খুবই কম। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে চিনি উৎপাদন হয় প্রায় ২৫ হাজার টন। একই সময়ে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত চিনি বাজারজাত হয় ২৫ লাখ টন। অর্থাৎ চিনির বাজার ৯৯ শতাংশই আমদানির ওপর নির্ভরশীল। 

চিনির বাজার স্বাভাবিক করতে শুল্ক কমানোর সুপারিশ করে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিনির ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (৩০ শতাংশ) প্রত্যাহারে আমরা এনবিআরকে চিঠি দিয়েছি। এখন বিষয়টি এনবিআর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে।’

চিনির ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (৩০%) প্রত্যাহারে আমরা এনবিআরকে চিঠি দিয়েছি। এখন বিষয়টি এনবিআর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে।
তপন কান্তি ঘোষ, বাণিজ্যসচিব

বাজার নিয়ন্ত্রণে শুধু শুল্ক কমানোই নয়, গত সেপ্টেম্বর থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পাঁচ মাসে চারবার চিনির দাম বেঁধে দেয় সরকার। তাতেও চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।

দেশে চিনির ব্যবহার বাড়ছে। একসময় কেবল ঘরে ও রেস্তোরাঁয় মিষ্টিজাতীয় পণ্য তৈরিতে চিনির ব্যবহার হতো। বর্তমানে খাদ্যপণ্যশিল্পের আকার বাড়ায় এই শিল্পেও চিনির চাহিদা বাড়ছে। আমদানি ও উৎপাদন মিলিয়ে এখন বছরে ২২-২৩ লাখ টন চিনি ব্যবহার হচ্ছে। আমদানির সিংহভাগই কাঁচা চিনি। এই কাঁচা চিনি দেশীয় পরিশোধন কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে তা বাজারে ছাড়া হয়।

মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সরকারের আয়ও বাড়ছে

অপরিশোধিত চিনি আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ, মূল্য সংযোজন কর মূসক বা ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ও অগ্রিম কর ৫ শতাংশ দিতে হয়। এর বাইরে প্রতি টন অপরিশোধিত চিনিতে কাস্টমস শুল্ক রয়েছে তিন হাজার টাকা।

চিনিতে ট্যারিফ ভ্যালু টনপ্রতি ৩৫০ ডলার ধরে করভার হিসাব করা হয়। বিশ্ববাজারে চিনির দাম বাড়ায় আমদানিকারকেরা এখন প্রতি টন ৪৭০-৪৮০ ডলার দাম ঘোষণা দিচ্ছেন। এতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ট্যারিফ ভ্যালু বাদ দিয়ে আমদানিকারকদের ঘোষণা দেওয়া দর ধরে চিনির শুল্কায়ন করছে।  

এ মাসে যেসব চিনি আমদানি হচ্ছে, সেগুলোতে প্রতি কেজিতে এখন ৩০-৩২ টাকা শুল্ক-কর দিতে হয়। শুল্ক-কর কমানো হলে চিনির দামও কমবে।
গোলাম রহমান, মহাসচিব, সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন 

জানতে চাইলে সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কাস্টমস এখন ডলারের বিনিময়মূল্য ১০৬ টাকা ধরে শুল্কায়ন করছে। এতে চিনিতে করভার আরও বেড়েছে।  এ মাসে যেসব চিনি আমদানি হচ্ছে সেগুলোতে প্রতি কেজিতে এখন ৩০-৩২ টাকা শুল্ককর দিতে হয়। শুল্ককর কমানো হলে চিনির দামও কমবে।

রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে দেখা যায়, ২০২২ সালে গড়ে প্রতি কেজি চিনি আমদানিতে সরকার শুল্ককর পেয়েছে প্রায় ২২ টাকা। এ বছরে অর্থাৎ চলতি জানুয়ারি মাসে যেসব চিনি বাজারজাত হয়েছে, সেগুলোতে করভার কেজিপ্রতি ২৯ টাকা পরিশোধ করেছেন ব্যবসায়ীরা। বন্ডের আওতায় নতুন করে বেশি দামে যেসব চিনি আমদানি হয়েছে, তা খালাস হলে করভার আরও বাড়বে। করভার বৃদ্ধির চাপটা গিয়ে পড়বে ভোক্তাদের ওপর।

গত কয়েক বছরের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চিনি আমদানির বিপরীতে ধারাবাহিকভাবে সরকারের রাজস্ব আয় বেড়েছে। ২০২০ সালে চিনি থেকে রাজস্ব আয় হয় ৪ হাজার ১৪ কোটি টাকা, যা পরের বছর ২০২১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২২ সালে ৪ হাজার ৯১৭ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। গত বছরের মতো আমদানি হলেও এ বছর চিনিতে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের আশা করছেন এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অবশ্য করভার কমানো হলে এই আয় কমবে।

রাজস্ব বোর্ডের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, শুল্ক কমানো হলে যে সরকারের রাজস্ব আয় কমবে, সেটি খেয়ালে রেখেই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে করছেন তাঁরা।