অমর্ত্য সেন সবচেয়ে প্রভাবশালী নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ

অমর্ত্য সেন
ছবি: শুভজিৎ বাগচী

অমর্ত্য সেন এই জীবনে যত কাজ করেছেন, তার পেছনে যে বিষয়টি মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে সেটা হলো, মানবকল্যাণ। তিনি সব সময় মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন। সব স্তরের মানুষের সঙ্গে তিনি খুব স্বাভাবিকভাবে মিশে যান। মানুষও সে জন্য তাঁকে অনেক ভালোবাসে।

অর্থনীতিবিদ হিসেবে তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী। শুধু অর্থনীতিতেই নয়, রাজনীতি ও জননীতি প্রণয়নে তাঁর অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে। সে জন্য ধারণা করা হয়, নোবেল পাওয়া অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অমর্ত্য সেন সবচেয়ে প্রভাবশালী।

একবার ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে অমর্ত্য সেন ও বিখ্যাত ভারতীয় চিত্রতারকা অমিতাভ বচ্চন উপস্থিত ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে দর্শকেরা অমিতাভ বচ্চনের চেয়ে অমর্ত্য সেনের বিষয়ে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেন। মানুষের প্রতি তাঁর যে মমত্ববোধ, এটি তাঁর প্রতিদান।

অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ৯০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইডিএসের সেমিনার কক্ষে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন অমর্ত্য সেনের সহপাঠী এবং দীর্ঘদিনের বন্ধু, অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, অমর্ত্য সেন সারা জীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। কিন্তু শেষ জীবনে এসে তিনি ভারতের কর্তৃত্ববাদী সরকারের কোপানলে পড়েছেন। তাতে অবশ্য তিনি দমে যাননি, আগে যেমন ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতেন, এখনো তেমন করছেন।

অর্থনীতিবিদ হিসেবে অমর্ত্য সেনের যে প্রভাব, তাঁর সঙ্গে নোবেল বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ মিলটন ফ্রিডম্যানের সাদৃশ্য খুঁজে পান রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, নোবেল পাওয়া অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অমর্ত্য সেন সবচেয়ে প্রভাবশালী।

বন্ধু হিসেবে রেহমান সোবহান যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করেন সেটি হচ্ছে, অমর্ত্য সেনের মানবিকতা। অনেকটা অনুযোগের সুরে তিনি বলেন, অমর্ত্য সেন আমন্ত্রণ পেলে না করতে পারেন না, পাছে মানুষ আহত হয় বা তাঁকে বড়বাবু হিসেবে ভাবে। এই বয়সেও তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে যান, এমনকি সে জন্য নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করতেও কুণ্ঠিত হন না।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘অমর্ত্য সেনের একাডেমিক জীবন সম্পর্কে আমার বলার কিছু নেই। আজ এখানে যাঁরা উপস্থিত আছেন, তাঁরাই সে বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। তবে তিনি সারা জীবন যে আদর্শের কথা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু সেই আদর্শের অনুসারী ছিলেন। সে কারণে তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করেছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট খোঁজখবর রাখেন, সে বিষয়ে অনেক কথা তিনি বলেছেন, তাঁকে ধন্যবাদ।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, অমর্ত্য সেন নিঃসন্দেহে একজন বিশ্ব নাগরিক, তাঁর আত্মজীবনীর নাম সেটাই বলে। কিন্তু ১৯৯৮ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর অমর্ত্য সেন প্রথম ঢাকায় এসেছিলেন, কলকাতায় নয়। ঢাকায় এসে তিনি নিজের স্কুল সেন্ট গ্রেগরিজ ও শৈশবে যে বাড়িতে ছিলেন, সেখানেও গিয়েছিলেন। অর্থাৎ মানুষ যত বড়ই হোন না কেন, শেষমেশ তিনি নিজের শিকড়ের কাছে ফেরেন।

অমর্ত্য সেনের চিন্তা সম্পর্কে ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, তিনি সব সময় উদার গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় গুরুত্ব দেন। তবে দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের মতো কর্তৃত্ববাদী দেশ গণতান্ত্রিক ভারতের চেয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে যে ভালো করেছে, সে কথা তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন। তবে তিনি এসব দেশের শাসনব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। উদার গণতন্ত্র যে উন্নয়নের সহায়ক, সে কথাও তিনি জোর দিয়ে বলেছেন।

অমর্ত্য সেন একই সঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক হিসেবে পরিচিত। তিনি মূলত কেনেথ অ্যারো সামাজিক চয়ন তত্ত্বের বিকাশ ঘটিয়ে ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান।

অমর্ত্য সেনের কাজের ওপর আলোকপাত করে অর্থনীতিবিদ এস আর ওসমানী বলেন, ১৯৪০-এর দশকে কল্যাণ অর্থনীতি একধরনের স্থবিরতার মধ্যে পড়েছিল। অমর্ত্য সেন একক কৃতিত্বে কল্যাণ অর্থনীতিকে সেই দুর্দশা থেকে বের করে নিয়ে আসেন। অর্থনীতিবিদেরা মানুষকে র‍্যাশানাল বা যৌক্তিক জীব হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। সেই যৌক্তিক মানুষের সংজ্ঞা সম্প্রসারণ করে অমর্ত্য সেন দেখান যে মানুষ একই সঙ্গে আদর্শ ও পরার্থপরতার আলোকে আত্মত্যাগ করে। এটা মানুষের একধরনের অঙ্গীকার, যার ওপর তিনি প্রভূত জোর দেন। তিনি নৈতিকতার সঙ্গে অঙ্গীকারের যোগসূত্র স্থাপন করেন। সেই সঙ্গে যেকোনো ধরনের বিতর্ক বা মতভেদের সমাধান খুঁজতে তিনি জনবিতর্কের পরামর্শ দেন।

অনুষ্ঠানে অমর্ত্য সেনের কর্মজীবন ও ব্যক্তিজীবনের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অর্থনীতিবিদ নজরুল ইসলাম। এতে তিনি অমর্ত্য সেনের সঙ্গে নিজের দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের নানা দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অমর্ত্য সেন পৃথিবীর সেই সব বিরল মানুষদের মধ্যে একজন, যিনি বুদ্ধিবৃত্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠেও মানবিকতা ভুলে যান না।

মানুষের প্রতি তাঁর দরদ অপরিসীম। তিনি একজন ক্ষণজন্মা মানুষ। তাঁর বয়স হয়েছে ৯০ বছর; স্বাভাবিকভাবেই শরীর অশক্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু এই বয়সেও তিনি হার মানেন না। এখনো তিনি দক্ষিণ এশিয়ার নারী-পুরুষের বৈষম্য নিয়ে বই লিখছেন।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, ‘অর্থনীতিবিদ হিসেবে তাঁর কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি শেখা প্রয়োজন সেটা হলো, অর্থনীতির সঙ্গে নৈতিকতার সমন্বয়, যে কাজটা আমাদের সব সময় করা উচিত।’

অমর্ত্য সেনের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপের উল্লেখ করেন বিনায়ক সেন। বলেন, প্রথম আলো থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক প্রতিচিন্তার প্রথম সংখ্যা পেয়ে অমর্ত্য সেন নামটি সম্পর্কে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। সবকিছু সম্পর্কে তাঁর মধ্যে একধরনের উচ্ছ্বাস আছে।

অনুষ্ঠানে বিআইডিএসের গবেষকসহ দেশের অর্থনীতিবিদেরা উপস্থিত ছিলেন।