ঋণের শর্তের আলোচনা শুরু

আইএমএফের সফররত দলটি ৯ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করবে। গতকাল প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।  

অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা। প্রায় সব সূচকই মানুষের বিপক্ষে। মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। কমতির দিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। পরিস্থিতির যাতে আরও অবনতি না হয়, সে জন্য সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশে এখন জ্বালানিসংকটও প্রকট। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী দুই দিন আগেই বলে দিয়েছেন, ‘আমাদের রিজার্ভ অনেক কমে গেছে। আমাদের হাতে টাকা নেই। সামনে কী হবে, এখনই বলা যাচ্ছে না।’

এ রকম এক পরিস্থিতিতে ঢাকায় এসেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি প্রতিনিধিদল। ঋণ চেয়ে গত জুলাইয়ে আইএমএফের কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ, সে ব্যাপারে আলোচনা করতেই দলটি এখন ঢাকায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে চায় ৪৫০ কোটি ডলার।

সচিবালয়ে গতকাল বুধবার সফররত আইএমএফের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের তিনটি আলাদা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আইএমএফের ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ। অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন একটি বৈঠকে অংশ নেন। অন্য দুই বৈঠকে বাংলাদেশের দিক থেকে নেতৃত্ব দেন অর্থ বিভাগের দুজন অতিরিক্ত সচিব।

আইএমএফের ঋণের দরকার হয়ে পড়েছে, যার মূল কারণ হচ্ছে রিজার্ভ কমে গেছে। সংস্থাটি এখন ঋণের শর্ত কী দেয়, দেখতে হবে। সাধারণত যে কাজগুলো সরকারের এমনিতেই করা উচিত, আইএমএফের শর্তের মধ্যে এগুলোই থাকে। বাস্তবায়ন করা যাবে না—এমন কিছু পারতপক্ষে থাকে না।
মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সামগ্রিক বিষয়ে

সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমানোর পরামর্শ

জানা গেছে, আইএমএফ দল একটি বৈঠকে সঞ্চয়পত্রের নানা দিক জানতে চেয়েছে এবং এ বিষয়ে তাদের অভিমত জানিয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্যও জানতে চেয়েছে তারা। আইএমএফ চায় সঞ্চয়পত্রের সুদের হার আরও কমিয়ে আনুক বাংলাদেশ এবং এ হার অন্তত বাজারদরের কাছাকাছি থাকুক। ব্যাংকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রাখলে যে সুদ পাওয়া যায়, সেটাকেই বাজারদর বলা হয়ে থাকে।

বৈঠকে বন্ডের সুদের হারসহ বন্ডবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়েও জানতে চেয়েছে আইএমএফের দল। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবে। এতে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ঋণের সুদ বাড়বে। সেসব ঋণের মূল টাকা ও সুদ কীভাবে পরিশোধ করা হবে—এসব বিষয় নিয়েও দলটি অর্থ বিভাগের কাছে প্রশ্ন করেছে।

আজ বৃহস্পতিবার বৈঠক হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে। এরপর একে একে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনসহ (বিইআরসি) বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করবে আইএমএফ। দলটির সঙ্গে আগামী ৮ বা ৯ নভেম্বর শেষ বৈঠক হবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের।

বৈঠক শেষে গতকাল অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে প্রথম বৈঠক এটি। ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। বৈঠক আরও হবে।’

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সভার ফাঁকে অনুষ্ঠিত আইএমএফের সঙ্গে যে বৈঠক হয়েছে, তাতেই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে ঋণ পাওয়া যাবে।

সঞ্চয়পত্রের সুদ কত বেশি

সঞ্চয়পত্রের সুদের হার নিয়ে ১১ মাস আগে থেকে তিনটি স্তর চালু রয়েছে। সে অনুযায়ী কম টাকা বিনিয়োগকারীরা বেশি সুদ পাচ্ছেন, আর বেশি টাকা বিনিয়োগকারীরা পাচ্ছেন কম সুদ। তারপরও বর্তমান হার বাজারদরের চেয়ে বেশি বলে মনে করছে আইএমএফ।

১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের বিপরীতে সুদের হার সর্বোচ্চ ১১ দশমিক শূন্য ৪ থেকে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, ১৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ১০ থেকে ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং ৩০ লাখের বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ৯ দশমিক ৩০ থেকে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে আইএমএফকে জানানো হয়েছে, ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের বিপরীতে যে সুদ দেওয়া হয়, তা প্রায় বাজারদরের সমান। আর এক বছরও হয়নি তিনটি আলাদা সুদের হার করা হয়েছে। এটা একধরনের সংস্কার। তা ছাড়া সঞ্চয়পত্র কেনায় অনলাইন পদ্ধতি চালু, সঞ্চয়পত্রে বেশি বিনিয়োগে করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) থাকার শর্ত আরোপ করা হয়েছে।

সঞ্চয়পত্রের সুদের হারে সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে এবং সরকারের পক্ষ থেকে একে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতের আওতায় থাকা বিষয় হিসেবেও বিবেচনা করা হয় বলে আইএমএফকে জানানো হয়। বলা হয়, এর একটি রাজনৈতিক গুরুত্বের দিকও রয়েছে। সুতরাং চাইলেই সুদের হার কমানো যাবে না।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা আছে সঞ্চয়পত্রের সুদ ভর্তুকি হিসেবে। অর্থাৎ ব্যাংকে টাকা রাখলে আমানতকারী হিসেবে যে টাকা পাওয়া যেত, বদলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের কারণে সরকারকে যে পরিমাণ বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে, সে টাকাই হচ্ছে এই ৮ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশের ঋণ চাওয়ার নেপথ্যে

আইএমএফকে গত জুলাইয়ে দেওয়া এক চিঠিতে সংস্থাটি থেকে ঋণ পাওয়ার যৌক্তিক কারণ তুলে ধরে বাংলাদেশ। এতে বলা হয়, গত ১৩ বছরে দেশে টেকসই সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থাই ছিল। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারও অর্জিত হয়েছে ভালো।

তবে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেশের অর্থনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। বিশ্ববাজারে অভূতপূর্ব হারে বেড়ে গেছে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও নিত্যপণ্যের দাম। ব্যাহত হয়েছে সরবরাহব্যবস্থাও।

চিঠিতে প্রবাসী আয়ের নেতিবাচক চিত্রও তুলে ধরা হয়। বলা হয়, প্রধান শ্রমবাজারগুলোতে কোভিডের প্রভাব কাটিয়ে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার দেরিতে হওয়ায় চলতি অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দেয় ১ হাজার ৭২৩ কোটি ডলার। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতি ছিল ২৭৮ কোটি ডলার।

চিঠিতে আরও বলা হয়, চলমান লেনদেনের ভারসাম্য ও আমদানি করা মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপণ্যের দামের ওপর প্রভাব পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশকে বিশ্বের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশে পরিণত করেছে। সব মিলিয়ে এখন সময় একটু খারাপ (ক্রিটিক্যাল টাইম)। জরুরি ভিত্তিতে লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রাখা ও বাজেট-সহায়তা বাবদ বাংলাদেশের অর্থের দরকার।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম সামগ্রিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আইএমএফের ঋণের দরকার হয়ে পড়েছে, যার মূল কারণ হচ্ছে রিজার্ভ কমে গেছে। সংস্থাটি এখন ঋণের শর্ত কী দেয়, দেখতে হবে। সাধারণত যে কাজগুলো সরকারের এমনিতেই করা উচিত, আইএমএফের শর্তের মধ্যে এগুলোই থাকে। বাস্তবায়ন করা যাবে না—এমন কিছু পারতপক্ষে থাকে না।

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সঞ্চয়পত্রের সুদের হার যদি আরও কমাতে বলে থাকে আইএমএফ, আমি একে সমর্থন করি। কারণ, বাজারের চেয়ে এ হার বেশি। এ সুদের হারের কারণে সরকারের ঋণের বোঝা বাড়ে।’ রাজস্ব আয়ে ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার বৃদ্ধি, নতুন করদাতার সন্ধান, কর-জিডিপি হারের উন্নতির বিষয়ে আইএমএফ কথা বলবে এবং সরকারও সেগুলো অনুসরণ করবে বলে আশাবাদী মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় রয়ে গেছে। নানা ধরনের মুদ্রা বিনিময় হার এখন চালু। এ বিভ্রান্তি দূর করা জরুরি। আইএমএফও এ নিয়ে পরামর্শ দিতে পারে।