ব্যাংকাস্যুরেন্সে লাভবান হবে ব্যাংক-বিমা দুই খাতই
দেশে ১ মার্চ জাতীয় বিমা দিবসে ব্যাংকাস্যুরেন্স সেবা চালু হয়েছে। এরপর বিভিন্ন ব্যাংক ও বিমা কোম্পানির মধ্যে এক এক করে চুক্তি হচ্ছে। ইতিমধ্যে আটটি ব্যাংক ব্যাংকাস্যুরেন্স সেবা চালু করেছে।
একসময় বিমা প্রতিনিধিদের (এজেন্ট) কাজ থাকবে না, এমন বক্তব্যের বিরোধিতা করতেন বিমা কোম্পানির মালিকপক্ষের একাংশ। কিন্তু বিমা প্রতিনিধিদের কাজ না থাকা বা কমে যাওয়ার বিষয়টিই যেন এখনকার বাস্তবতা, যার নাম ব্যাংকাস্যুরেন্স। দেশে সম্প্রতি এই সেবা চালু হয়েছে। ব্যাংকগুলো ইনস্যুরেন্স (বিমা) সেবাটি দিচ্ছে বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে ব্যাংকাস্যুরেন্স। এতে বিমা প্রতিনিধিদের কাজ যে ব্যাপক হারে কমে যাবে, তা নিঃসন্দেহ।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ব্যাংকের মাধ্যমে বিমাসেবা দেওয়ার যৌক্তিকতা এবং এর বাজার চাহিদা রয়েছে। সে লক্ষ্যে সরকার প্রায় ১০ বছর ধরে সেবাটি চালুর চেষ্টা করে আসছিল। সব ধরনের আইনি ধাপ পার করে অবশেষে ১ মার্চ জাতীয় বিমা দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাংকাস্যুরেন্স সেবার উদ্বোধন করেন।
উদ্বোধন–পরবর্তী দুই সপ্তাহের মধ্যে মিলিয়ে আটটি ব্যাংক ব্যাংকাস্যুরেন্স সেবা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এগুলো হচ্ছে স্থানীয় দি সিটি ব্যাংক, ডাচ্–বাংলা ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ইস্টার্ণ ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) এবং বিদেশি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। এসব ব্যাংক ইতিমধ্যে কয়েকটি সাধারণ (নন-লাইফ) ও জীবনবিমা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই করেছে। যেসব বিমা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে সেগুলো হচ্ছে গ্রীন ডেলটা ইনস্যুরেন্স, রিলায়েন্স ইনস্যুরেন্স, প্রগতি লাইফ ইনস্যুরেন্স, গার্ডিয়ান লাইফ ও মেটলাইফ বাংলাদেশ।
মেটলাইফ বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও ইবিএল। গার্ডিয়ান লাইফের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে দি সিটি, ডাচ্-বাংলা ও এমটিবির। আর প্রগতি লাইফ, গ্রীন ডেলটা ও পাইওনিয়ার ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে এমটিবি চুক্তি করেছে। এবি ব্যাংক চুক্তি করেছে প্রগতি লাইফের সঙ্গে। ব্র্যাক ব্যাংক চুক্তি করেছে গ্রীন ডেলটা ইনস্যুরেন্সের সঙ্গে। চার্টার্ড লাইফের সঙ্গে চুক্তি করেছে এক্সিম ব্যাংক। এ ছাড়া রিলায়েন্স ইনস্যুরেন্স চুক্তি হয়েছে দি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) নীতিমালা অনুসরণ করে চুক্তিগুলো সই হয়। এর মধ্যে কোনো কোনো ব্যাংক বিমাসেবা বিক্রির কার্যক্রম শুরু করতে পারলেও কেউ কেউ এখনো পারেনি।
ব্যাংকাস্যুরেন্স নামের এই বিমা পণ্য বিক্রির বিপরীতে ব্যাংক নির্ধারিত হারে বিমা কোম্পানির কাছ থেকে কমিশন পাবে। সেবাটি তদারকির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ব্যাংকাস্যুরেন্স নামে আলাদা শাখা খোলা হয়েছে। আইডিআরএ নিজেও বিমাসংক্রান্ত অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য আলাদা ইউনিট চালু করেছে। বিমা কোম্পানিগুলো কমিশন ভাগাভাগি করে ব্যাংকের মাধ্যমে নিজেদের পণ্যের প্রসার ঘটাতে পারবে। এতে উভয় পক্ষেরই লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকবে।
ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু হলেও জিনিসটি কী এবং কোথা থেকে এল, তা একটু বলে নেওয়া যাক। ব্যাংকাস্যুরেন্সের ইতিহাস আসলে বেশি পুরোনো দিনের নয়। কোনো বিমা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে ব্যাংক যদি তার গ্রাহকদের কাছে ওই বিমা কোম্পানির পণ্য তথা সেবা বিক্রি করে, সেটাই হল ব্যাংকাস্যুরেন্স। এটি ফরাসি শব্দ। ১৯৮০ সালের দিকে ফ্রান্স ও স্পেনে প্রথম এটি চালু হয়। এরপর আমাদের প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা সফলভাবে চলছে।
ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে এখন ব্যাংকের মাধ্যমে জীবনবিমা পলিসি বিক্রি হয়। ভারতে মোট বিমা পলিসি বিক্রির ২০ শতাংশ এবং তুরস্কে প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যাংকাস্যুরেন্সের মাধ্যমে হয় বলে বিমাবিষয়ক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
আইডিআরএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকাস্যুরেন্সের ক্ষেত্রেও বিমাদাবি বা অভিযোগ নিষ্পত্তি হবে বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী। ব্যাংক কিন্তু দাবি পরিশোধের নিশ্চয়তা দেবে না। ব্যাংক থেকে পলিসি কিনতে গেলে ব্যাংকে হিসাব থাকতে হবে। বিমা কোম্পানির মাধ্যমে একই পলিসি কিনতে গেলে ব্যাংক হিসাব শুরুতে না থাকলেও চলে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ব্যাংক হিসাব খোলা বাধ্যতামূলক।
দেশে চালুর প্রথম দুই সপ্তাহে কতজন ব্যাংকাস্যুরেন্স সেবার গ্রাহক হয়েছেন, তা জানার জন্য যোগাযোগ করা হলে আইডিআরএর মুখপাত্র ও পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে জানান, ‘মাত্র তো শুরু হলো। এখনো উল্লেখ করার মতো কোনো সংখ্যা নেই। তবে মাসখানেক পার হলে কিছুটা বোঝা যাবে।’
চুক্তি করতে কী কী লাগবে
কোনো ব্যাংক যদি ব্যাংকাস্যুরেন্স সেবা চালু করতে চায়, তাহলে প্রথমেই সেটির পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিতে হবে। অনুমোদনের কপিসহ আবেদন করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকে। আবেদনের সঙ্গে ব্যাংকের দুই বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন, ঋণমান, খেলাপি ঋণের হারসহ ২০ ধরনের তথ্য দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পূর্বানুমতি নেওয়ার পর আইডিআরএ থেকে করপোরেট এজেন্ট হিসেবে লাইসেন্স নিতে হবে। এরপর সংশ্লিষ্ট বিমা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা লাগবে।
অন্যদিকে বিমা কোম্পানিকে ব্যাংকাস্যুরেন্সের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তির অনুমোদন পেতে আইডিআরএতে সাত ধরনের তথ্য দিতে হবে। ১৩ মার্চ বেসরকারি সব জীবনবিমা কোম্পানিকে পাঠানো এক চিঠিতে আইডিআরএ এ নির্দেশনা দিয়েছে।
করপোরেট এজেন্ট (ব্যাংকাস্যুরেন্স) নির্দেশিকা, ২০২৩ অনুযায়ী ব্যাংকাস্যুরেন্স চুক্তি সম্পাদনের অনুমোদনের আবেদনে প্রয়োজনীয় সব তথ্য দাখিল করতে হবে। তথ্যগুলো হচ্ছে বিমা দাবি নিষ্পত্তির হার, অনুমোদিত ব্যবস্থাপনা ব্যয় ও প্রকৃত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের পরিমাণ, মোট সম্পদের কত শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে ও কত শতাংশ তারল্যে রূপান্তর করা যাবে, কোম্পানির বিনিয়োগ রিটার্নের হার, জীবন তহবিলের পরিমাণ, নবায়ন হার এবং ব্যাংকাস্যুরেন্স চুক্তির খসড়া।
বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন আহমেদের মতে, ব্যাংকাস্যুরেন্স সেবা পুরো বিমা খাতকে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
দাবি পরিশোধে ব্যাংকের দায়িত্ব নেই
ব্যাংকাস্যুরেন্স হচ্ছে চুক্তি, কোনো বিমা পণ্য নয়। এ চুক্তির মাধ্যমে বিমা কোম্পানির পক্ষে তাদের পণ্য বা পলিসি বিক্রি বা বাজারজাত করে থাকে ব্যাংক। অর্থাৎ ব্যাংক এখানে কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। গ্রাহকের বিমাদাবি পরিশোধে বিমা কোম্পানির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
দাবির বেলায় বিমাগ্রাহক বা তাঁর নমিনি বিমা কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ অথবা ব্যাংকের মাধ্যমেও যোগাযোগ করতে পারবেন। দাবি গ্রহণযোগ্য হলে বিমা কোম্পানি সরাসরি বিমাগ্রাহক বা তাঁর নমিনিকে চেক দেবে এবং ব্যাংককে জানিয়ে দেবে। তবে দাবির টাকা পরিশোধের ব্যাপারেও আইনগতভাবে ব্যাংকের কোনো দায়দায়িত্ব থাকবে না।
ব্যাংকাস্যুরেন্স চালুর ক্ষেত্রে ব্যাংকের আর্থিক সূচকের মানদণ্ড ঠিক করে দিয়ে গত ডিসেম্বরে নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বলা হয়েছে, ব্যাংককে বিমাকারীর বিমাসংক্রান্ত কোনো ঝুঁকি গ্রহণ করবে না বা বিমাকারী হিসেবে কাজ করবে না মর্মে স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিতে হবে।
দি সিটি ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ও কান্ট্রি বিজনেস ম্যানেজার আশানুর রহমান বলেন, ‘ব্যাংকাস্যুরেন্সে আমাদের মনোযোগ রয়েছে। ভালো মানের কোম্পানি ছাড়া যেহেতু আমরা কারও সঙ্গে চুক্তি করিনি, সেহেতু এ কথা বলা যায় যে গ্রাহকেরা আমাদের কাছ থেকে পরামর্শও পাবেন ভালো।’
আশানুর রহমান আরও বলেন, ‘বিক্রি ভালো মাত্রায় শুরু না হলেও আমরা আশাবাদী। এটা সত্য যে গ্রাহকদের সব প্রশ্নের জবাব দিতে হলে ব্যাংকারদের আরও বিমা বোঝার দরকার আছে। সে চেষ্টাই আমরা করছি।’
টানা তিন বছর মুনাফায় থাকা চাই
করপোরেট এজেন্ট হিসেবে বিমাপণ্য ও সেবা বিক্রি করতে চাইলে কোনো ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিতে হবে। অনুমোদন পাওয়ার পর ব্যাংককে স্বতন্ত্র ব্যাংকাস্যুরেন্স ইউনিট বা উইং প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংক কোনো গ্রাহককে বিমাপণ্য গ্রহণে বাধ্য করতে পারবে না, কোনো গ্রাহককে বিমাপণ্য ক্রয়ে উৎসাহিত করার জন্য বিমা কোম্পানি ঘোষিত মূল্য ছাড়া অন্য কোনো প্রণোদনাও দিতে পারবে না। ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু করতে আগ্রহী ব্যাংককে পরপর তিন বছর মুনাফা অর্জন করতে হবে।
একটি ব্যাংক একই সঙ্গে সর্বোচ্চ তিনটি জীবনবিমা ও তিনটি সাধারণ বিমার পণ্য-সেবা বিক্রি করতে পারবে। যেসব ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের কম, তারাই শুধু এ সেবায় যুক্ত হতে পারবে। সে ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মূলধনের বিপরীতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের (সিআরএআর) অনুপাত হতে হবে সাড়ে ১২ শতাংশ। ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া ক্রেডিট রেটিং বা ঋণমানে গ্রেড-২-এর নিচে থাকা ব্যাংক বিমা ব্যবসায়ে যুক্ত হতে পারবে না। আগ্রহী ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিংও ন্যূনতম ২ থাকতে হবে। খেলাপি ঋণের বিষয়ে বলা হয়েছে, নিট খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশের বেশি হতে পারবে না।
এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক মাইন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকাস্যুরেন্সের মাধ্যমে বিমা খাতের প্রসার ঘটবে, এতে সন্দেহ নেই। এটি সফল হলে দেশের বিমা খাতের দীর্ঘদিনের কলঙ্ক কিছুটা হলেও কেটে যাবে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও উপকৃত হবে দুভাবে। একটি হচ্ছে বিমা সেবা বিক্রির ওপর কমিশন। এতে তাদের মুনাফা বাড়বে।
অন্যটি হচ্ছে ব্যাংকাস্যুরেন্স সেবা বিক্রির জন্য ব্যাংকগুলোকে যে কিছু মানদণ্ড বজায় রাখতে হবে, তা তাদের সামগ্রিক কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করবে। যেমন ব্যাংকাসুরেন্সের জন্য ব্যাংকগুলোকে তাদের খেলাপি ঋণ কমাতে হবে, ন্যূনতম মূলধন অনুপাত বজায় রাখতে হবে এবং টানা তিন বছর নিট মুনাফা অর্জন করতে হবে। এগুলো পূরণ করতে পারলে ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে।