ইসলামি বিমা কোম্পানি শুধু নামেই আছে, কাজে নেই

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) প্রথমবারের মতো দেশে ইসলামি বিমা বিধিমালা করছে। 

দেশের জীবনবিমা খাতের অন্তত ১১টি প্রতিষ্ঠান নামের সঙ্গে ‘ইসলামি’ শব্দ জুড়ে দিয়ে এখন ইসলামি বিমা কোম্পানি হিসেবে পরিচিতি গড়ে তুলেছে। অবশেষে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) নজরে এসেছে যে বাস্তবে এসব কোম্পানির কোনো ইসলামি পণ্যসেবা নেই। এমনকি ইসলামি ভাবধারায়ও চলছে না কোম্পানিগুলো।

এ অবস্থায় আইডিআরএ দেশে প্রথমবারের মতো ইসলামি বিমা বিধিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। সংস্থাটি এ নিয়ে একটি খসড়া তৈরি করে সেটি ১০ মার্চ বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি, বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স ফোরাম, বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স একাডেমিসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কাছে মতামতের জন্য পাঠিয়েছে। আর ১৭ মার্চের মধ্যে ই-মেইলে মতামত দিতে বলা হয়েছে।

আইডিআরএর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে যেসব কোম্পানি নামের সঙ্গে ‘ইসলামি’ শব্দ জুড়ে দিয়ে জীবনবিমা কোম্পানি পরিচালনা করছে, সেগুলো হচ্ছে আলফা ইসলামী লাইফ, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ, বেঙ্গল ইসলামী লাইফ, পদ্মা ইসলামী লাইফ, প্রাইম ইসলামী লাইফ, প্রটেকটিভ ইসলামী লাইফ, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ, জেনিথ ইসলামী লাইফ, এনআরবি ইসলামিক লাইফ ও আকিজ তাকাফুল লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি।

বেশ কিছু কোম্পানির নামের সঙ্গে শুধু ‘ইসলামি’ শব্দটা আছে, আর কিছু নেই। পরিপূর্ণ কোনো ইসলামি বিমা পরিকল্প বা পণ্য নেই। এভাবে চলতে পারে না। তাই একটা বিধিমালা করা হচ্ছে। এ-সংক্রান্ত খসড়ায় সবার মতামত চাওয়া হয়েছে। 
মো. জাহাঙ্গীর আলম মুখপাত্র ও পরিচালক, আইডিআরএ

রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বীমা করপোরেশন, বিদেশি মেটলাইফ ও ভারতের এলআইসির পাশাপাশি ইসলামি নাম যুক্ত করেনি, এ রকম আরও ২৩টি জীবনবিমা কোম্পানি রয়েছে দেশে।

জানতে চাইলে আইডিআরএর মুখপাত্র ও পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দেখেছি যে বেশ কিছু কোম্পানির নামের সঙ্গে শুধু “ইসলামি” শব্দটা আছে, আর কিছু নেই। পরিপূর্ণ কোনো ইসলামি বিমা পরিকল্প বা পণ্য নেই। এভাবে চলতে পারে না। তাই একটা বিধিমালা করা হচ্ছে। এ-সংক্রান্ত খসড়ায় সবার মতামত চাওয়া হয়েছে।’ ইসলামি বিমা বিধিমালা হয়ে গেলে শৃঙ্খলার সঙ্গে ইসলামি বিমাপণ্য বিক্রি করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।

ইসলামি পণ্য বিক্রি না করে শুধু নামে ইসলামি হয়ে কোম্পানিগুলো এত বছর মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। ইসলামি বিমা বিধিমালা করার উদ্যোগটি আরও আগে নেওয়া উচিত ছিল।
মাইন উদ্দিন, শিক্ষক, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ইসলামি লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির প্রতিনিধিরাও স্বীকার করেছেন, নামেই তাঁরা ইসলামি আছেন এবং আইডিআরএর বিধিমালা করার উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন। জেনিথ ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এস এম নুরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা প্রচলিত বিমাপণ্যই বাজারে বিক্রি করছি। বিনিয়োগটা শুধু ইসলামী ব্যাংকে করেছি।’

এদিকে বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) ১৮ মার্চ নিজস্ব কার্যালয়ে একটি বৈঠক ডেকেছে। এ বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে ইসলামি বিমা বিধিমালাও রয়েছে।

পদ্মা ইসলামী লাইফের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফকরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আসলে নামে ইসলামি হলেও জীবনবিমা কোম্পানিগুলো প্রচলিত জীবনবিমা কোম্পানির মতোই ব্যবসা করছে।

কী আছে খসড়ায় 

ইসলামি বিমা বিধিমালার খসড়ায় বলা হয়েছে, ইসলামি বিমা ব্যবসা করতে গেলে আগে আইডিআরএর কাছে আবেদন করতে হবে। আর্থিক সংগতি, শরিয়াহর ভিত্তিতে পরিচালনার সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে সন্তুষ্ট হলে আইডিআরএ অনুমতি দেবে। অনুমতি ছাড়া ইসলামি বিমা ব্যবসা করা যাবে না। প্রতি পঞ্জিকা বছরে কোম্পানিগুলোকে শরিয়াহ কাউন্সিল থেকে এ মর্মে প্রত্যয়নপত্র নিতে হবে যে তারা শরিয়াহসম্মতভাবে ব্যবসা পরিচালনা করেছে। সেই প্রত্যয়নপত্র আইডিআরএর কাছে দাখিল করতে হবে। আইডিআরএ যদি দেখে যে শরিয়াহ পরিপালন লঙ্ঘিত হয়েছে, তখন কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে সংস্থাটি সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ইসলামি বিমা ব্যবসা স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে।

খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো জীবনবিমা কোম্পানি যদি একই সঙ্গে প্রচলিত জীবনবিমা ব্যবসা ও ইসলামি বিমা ব্যবসা করতে চায়, তাহলে হিসাবসহ সবকিছু আলাদাভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। যে ইসলামি বিমা পলিসি বা পরিকল্পের জন্য বিমা কোম্পানিগুলো আইডিআরএর কাছে আবেদন করবে, সেগুলোর বিশদ বিবরণ সংস্থাটির কাছে তুলে ধরতে হবে। এর মধ্যে পলিসির পদ্ধতি, সুবিধা ও প্রিমিয়ামের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। পলিসিটি টেকসই বা কার্যকর কি না, সে ব্যাপারে পেশাগত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি বা অ্যাকচুয়ারির কাছ থেকে প্রতিবেদন নিতে হবে।

আইডিআরএর খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক ইসলামি বিমা ব্যবসাকারী কোম্পানিকে তিন সদস্যের শরিয়াহ কাউন্সিল গঠন করতে হবে, যার মধ্যে অন্তত একজনের অর্থনীতি, বাণিজ্য বা বিমা বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হবে। কাউন্সিলকে বছরে চারবার বৈঠক করতে হবে। ইসলামি বিমা ব্যবসাকারী কোম্পানি দাতব্য তহবিল গঠন করতে পারবে। তবে সুদযুক্ত ও অন্যান্য সন্দেহজনক আয় মুনাফার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।’

ইসলামি বিমা ব্যবসাপদ্ধতির বিষয়ে একটি তফসিলও থাকছে খসড়ায়, যেখানে ওয়াকালাহ-মুদারাবা মিশ্র (হাইব্রিড) পদ্ধতি নিয়ে একটি বিবরণ রয়েছে। এ পদ্ধতির আওতায় বিমাগ্রহীতাদের জন্য তাকাফুল তহবিল ও ইসলামি বিমা ব্যবসা তহবিল নামে দুটি তহবিল থাকবে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক মাইন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ইসলামি পণ্য বিক্রি না করে শুধু নামে ইসলামি হয়ে কোম্পানিগুলো এত বছর মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। ইসলামি বিমা বিধিমালা করার উদ্যোগটি আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল। দেরিতে হলেও আইডিআরএ যদি বিধিমালাটি করতে পারে, এ জন্য সংস্থাটি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।