বিমা খাতে আস্থাহীনতার বড় কারণ দাবি পরিশোধ না হওয়া

বিমা পলিসি করার ক্ষেত্রে প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে সামাজিক মতামত তথা বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের অভিমত।

দেশে জীবনবিমা পলিসি নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে মানুষের আস্থাহীনতা। এর বাইরে দাবি নিষ্পত্তিতে কোম্পানিগুলোর প্রক্রিয়াগত জটিলতা, গ্রাহকদের দীর্ঘমেয়াদে আর্থিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে অনীহা ও প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব এবং বিমা কোম্পানির এজেন্ট বা প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সন্তোষজনক সেবা না পাওয়াও বিমা খাতের বিকাশে বাধা হয়ে আছে।

দেশের বিমা খাতের সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও কৌশল নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। মেটলাইফ বাংলাদেশের সহযোগিতায় বেসরকারি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকস এই গবেষণা পরিচালনা করে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

গ্রাহকদের আস্থাহীনতার বড় কারণ তাঁদের বিমা দাবি পরিশোধ করতে পারছে না কোম্পানিগুলো। তবে সব কোম্পানি যে দাবি পরিশোধ করছে না তা নয়। ১৯টি কোম্পানি ৮০ থেকে ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত বিমা দাবি পরিশোধ করছে।
মোহাম্মদ জয়নুল বারী, চেয়ারম্যান, আইডিআরএ

গবেষণা প্রতিবেদনে বিমা খাতের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতার বিষয়টি উঠে এলেও এর পেছনের কারণগুলো সেভাবে উঠে আসেনি। যদিও বক্তারা বলেছেন, কোম্পানিগুলোর একাংশ দাবি পরিশোধ না করতে পারাই বিমার প্রতি গ্রাহকদের আস্থাহীনতার বড় কারণ। এ কারণে দেশের মানুষের মধ্যে জীবনবিমা গ্রহণের হার বাড়ছে না। মানুষ মনে করেন, ঝুঁকি দূর করতে গিয়ে আবার ঝুঁকি নেব নাকি। যদিও বিমা খাতের জন্য বাংলাদেশ খুবই সম্ভাবনাময়।

বিমা খাতের সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও কৌশল নিয়ে পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী। গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে
ছবি: সংগৃহীত

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) বিমা ও পুঁজিবাজার অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব অমল কৃষ্ণ মণ্ডল, এনএসইউর স্কুল অব বিজনেসের ডিন হেলাল আহমেদ, মেট লাইফ বাংলাদেশের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলা আহমদ প্রমুখ। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন এনএসইউর অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান নুরুল কবির ও জ্যেষ্ঠ প্রভাষক কাজী তাফসিরুল ইসলাম।

দেশের বিভিন্ন শহরের ১ হাজার ২৮০ জনের বেশি অংশগ্রহণকারীর কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া সংগ্রহের মাধ্যমে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। সব মিলিয়ে দুই বছর সময় নিয়ে এই গবেষণার কাজ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র দশমিক ৫০ শতাংশ বিমার গ্রাহক, যা বিশ্বের মধ্যে ৮৫তম। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে থাইল্যান্ডে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ৩০ মানুষ বিমার গ্রাহক। মালয়েশিয়া ও ভারতে বিমার গ্রাহক যথাক্রমে ৫ ও ৪ শতাংশ।

প্রতিবেদন মতে, দেশে জীবনবিমার গ্রাহক বাড়ছে না। ২০০৮ সালে দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে জীবনবিমার গ্রাহক ছিলেন দশমিক ৪০ শতাংশ। ২০১৯ সালে সেটি কমে দশমিক ৩৮ শতাংশ হয়। ২০২২ সালে সেটি আরও কমে দশমিক ২২ শতাংশে নেমে যায়। একইভাবে সাধারণ বিমা গ্রাহকের সংখ্যাও কমেছে। অথচ বিমার গ্রাহক ১ শতাংশ বাড়লে দেশের জিডিপিতে ২ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়।

জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, তাঁরা স্বাস্থ্যজনিত জরুরি অবস্থায়ই অর্থের জোগান নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। তা ছাড়া সন্তানদের শিক্ষা, অবসর-পরবর্তী অর্থায়ন, সম্পদ ক্রয়, ভ্রমণ ও অবসর কাটানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন নিয়েও উদ্বেগ আছে তাঁদের। অথচ বিমা শব্দটি শুনলেই প্রথমে তাঁদের মনে যে কথাটি আসে, সেটি হচ্ছে আস্থাহীনতা। এ ছাড়া প্রক্রিয়াগত জটিলতা, দাবি নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কথাও মনে হয় তাঁদের।

জরিপের উত্তরদাতারা বিমার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তা হলো বিমার সুবিধা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বিমা সেবা ডিজিটালাইজ করা, ভ্যালু অ্যাডেড সেবা প্রদান, ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলের সম্প্রসারণ ও বিমা খাতের সুশাসন নিশ্চিতে আরও জোর দেওয়ার প্রয়োজন আছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিমা পলিসি করার ক্ষেত্রে প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে সামাজিক মতামত। অর্থাৎ বিমা করার ক্ষেত্রে বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের মতামত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তার মানে আশপাশের মানুষ বা সমাজ যদি বিমা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা রাখে, তাহলে বিমার গ্রাহক বাড়বে। শিশুশিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, অপ্রত্যাশিত স্বাস্থ্য সমস্যা, সম্পদ ক্রয়, ভ্রমণ এবং অবসর-পরবর্তী অর্থায়নের জন্য সঞ্চয় বিষয়ে বিমা খাতের বড় সম্ভাবনা রয়েছে।

অতিরিক্ত সচিব অমল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, সাধারণ মানুষের কাছে জীবিত অবস্থায় কী সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, সেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী নতুন পণ্য নিয়ে আসতে হবে। ডিজিটাল ব্যবস্থা করা গেলে বিমা খাত নিয়ে গ্রাহকের মধ্যে আস্থা আসবে। ১ মার্চ থেকে ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু হবে। নতুন এই সেবার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিমা নিয়ে আস্থা বাড়বে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইডিআরএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, গ্রাহকদের আস্থাহীনতার বড় কারণ তাঁদের প্রত্যাশা মেটাতে বা বিমা দাবি পরিশোধ করতে পারছে না কোম্পানিগুলো। সব কোম্পানি যে দাবি পরিশোধ করছে না তা নয়। ১৯টি কোম্পানি ৮০ থেকে ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত বিমা দাবি পরিশোধ করছে। ১০টি কোম্পানি ৭০ শতাংশের ওপর দাবি পরিশোধ করছে। যারা দাবি পরিশোধ করে না, সেই সংখ্যাটা কম। কোম্পানিগুলোতে সুশাসনের অভাবের কারণেই দাবি পরিশোধ হচ্ছে না। পুরো বিমা খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।