মূল্যস্ফীতি কমলেও স্বস্তি কম

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, গত ডিসেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার কমে ৮.৭১ শতাংশে নেমেছে।

সওদা করতে থলে হাতে বাজারে যাওয়া ক্রেতা এখনো স্বস্তিতে নেই। অথচ মূল্যস্ফীতির সরকারি পরিসংখ্যানে স্বস্তির আভাস মিলছে। বাজারে নিত্যপণ্য কেনাবেচার খবর যা-ই হোক না কেন, মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান কিন্তু বেশ ভালো।

কারণ, টানা চার মাস মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার কমে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশে নেমে এসেছে। এই হার আগের মাস নভেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

বিবিএস গতকাল সোমবার মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। গত আগস্ট মাসে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ফলে ওই মাসে খাদ্যপণ্য, যাতায়াত, পোশাক-আশাকসহ সব ধরনের খরচ বেড়ে যায়। আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা এর আগের সোয়া ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসের পর এত মূল্যস্ফীতি আর হয়নি।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো সরকারি পরিসংখ্যানে আগস্ট–পরবর্তী চার মাসে ধারাবাহিকভাবে মূল্যস্ফীতি কমেছে। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম সরকারি হিসাবের চেয়ে বেশি। বিবিএসের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মূলত শীতের শাকসবজি ও মাছ-মাংসের দাম কমায় মূল্যস্ফীতি কমেছে।

সামনের দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতি কমার সুযোগ আছে। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম কমছে।
সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম

মূল্যস্ফীতি ওঠানামায় চালের দাম বড় ভূমিকা রাখে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি গণনায় চালের অবদান ১৩ শতাংশ। গত ডিসেম্বর মাসে বাজারে চালের দাম কমেনি। এক বছর আগের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বাজারে। সদ্য বিদায়ী ডিসেম্বরে মাসে মোটা চালের কেজিপ্রতি দাম ছিল ৪৮-৫৫ টাকা। এক বছর আগের একই মাসে সেই চালের দাম ছিল ৪৫-৪৮ টাকা। এটি আরেক সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, এখনো মূল্যস্ফীতির চাপ অনেক বেশি। শাকসবজি ও মাছ-মাংসের দাম কমলেও চালের দাম উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল আছে। সামনের দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতি কমার সুযোগ আছে। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম কমছে।

ফলে স্থানীয় বাজারেও জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের সুযোগ আছে। এটি করা হলে জিনিসপত্রের দাম কমতে পারে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলে দেশের বাজারে এর প্রতিফলন হতে সময় লাগে।

মূল্যস্ফীতির হিসাব ও জীবনযাত্রা

ডিসেম্বর মাসে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হওয়ার অর্থ হলো ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে একজন মানুষ যে পণ্য ১০০ টাকায় কিনতেন, সে পণ্য কিনতে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে খরচ হয়েছে ১০৮ টাকা ৭১ পয়সা।

তবে মানুষের আয় বৃদ্ধির সুখবর নেই। বিবিএস মূল্যস্ফীতি কমার খবর দিলেও স্বস্তি নেই মজুরি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে। মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বাড়লেও সেই তুলনায় মজুরি বাড়েনি। গত ডিসেম্বর মাসে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ০৩ শতাংশ। অর্থাৎ জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে প্রায় পৌনে ৯ শতাংশ। মানুষ এখন খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয় করতে পারছেন না।

তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা দিনদিন কমে যাচ্ছে। তাঁরা বাজার থেকে আগের মতো পণ্য কিনতে পারছেন না। দেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ কর্মসংস্থান হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে। তাঁদের আয় মজুরিভিত্তিক।

খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি ১০%

এবার মূল্যস্ফীতির নতুন চিত্র মিলছে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই করছে। সাধারণত খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের চেয়ে বেশি হয়। কয়েক মাস ধরেই এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। বিবিএস সূত্র বলছে, গত ডিসেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয় ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

গ্রামে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি এখনো ১০ শতাংশের বেশি আছে। গত ডিসেম্বর মাসে গ্রামে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। আগের মাসে ছিল ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ। গ্রামের মানুষের যাতায়াত, পোশাক-আশাক কিংবা চিকিৎসা খরচ বেড়েছে।

গ্রামে খাদ্যপণ্যে ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ১১ শতাংশ হয়েছে। সার্বিকভাবে শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি। সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখন গ্রামে ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ, আর শহরে ৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ। শহর ও গ্রাম—উভয় ক্ষেত্রে ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি কমেছে।