চাহিদা থাকলেও ট্রাকে টিসিবির পণ্য বিক্রি বন্ধ

টিসিবির ট্রাকফাইল ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি সামান্য কমলেও প্রায় তিন বছর ধরে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের আশপাশে। দীর্ঘ এই মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে তিন বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার ১০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশ। আর উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাজারে খাবারের জোগান দিতে পরিবারের আয়ের প্রায় ৫৫ শতাংশ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে।

অর্থনৈতিক এমন চাপ থেকে স্বল্প মানুষদের কিছুটা স্বস্তি দিতে সরকার ভর্তুকি মূল্যে ট্রাকে পণ্য বিক্রি করে থাকে। কিন্তু চাহিদা সত্ত্বেও এক মাস বিক্রির পর এ মাসের ১৩ তারিখ ট্রাক সেল বন্ধ করেছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, শহরাঞ্চলে সামাজিক সুরক্ষার তেমন কোনো কর্মসূচি নেই। তাই উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে কম আয়ের মানুষদের স্বস্তি দিতে টিসিবির ট্রাক সেল অব্যাহত রাখা উচিত। তবে বাজেটের সীমাবদ্ধতা এবং ব্যাপক ভর্তুকির কথা বলছেন সরকারি কর্মকর্তারা।

এ পণ্য বিক্রির জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার টিসিবিকে ১ হাজার ১৮১ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়। আর কার্যক্রম সম্প্রসারণ করায় গত অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা।

গত এক মাসের টিসিবির ট্রাক সেলের সামনে সাধারণ মানুষের দীর্ঘ সারি ছিল নিয়মিত চিত্র। ঢাকায় ৬০টি ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি করা হয়। এ পণ্য বিক্রির জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার টিসিবিকে ১ হাজার ১৮১ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়। আর কার্যক্রম সম্প্রসারণ করায় গত অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা।

ওএমএসের ট্রাকে ৩০০ লোকের জন্য চাল ও ৫০০ লোকের জন্য আটা থাকে। এক ব্যক্তি পাঁচ কেজি চাল ও চার কেজি আটা কিনতে পারেন। তাতে ব্যয় হয় ২৬০ টাকা, যা বাইরে থেকে কিনলে প্রায় ৫০০ টাকা লাগে।

২০২২ সালের পর থেকে টিসিবি ট্রাক সেল থেকে কার্ড ব্যবস্থায় চলে যায়। সারা দেশে ১ কোটি ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রি শুরু করে। নিত্যপণ্যের বার্ষিক বিক্রি এক লাখ টন থেকে বাড়িয়ে এখন তা প্রায় পাঁচ লাখ টনের লক্ষ্যমাত্রায় উন্নীত করেছে সংস্থাটি।

টিসিবির তথ্যমতে, একটি ট্রাকে ৫০০ জনের জন্য পণ্য থাকে। যেখান থেকে একজন ক্রেতা দুই কেজি মসুর ডাল, দুই লিটার সয়াবিন তেল ও এক কেজি চিনি কিনতে পারেন। তাতে মোট ব্যয় হয় ৪৫০ টাকা। বাইরে থেকে এ পণ্য কিনতে ৬২০-৬৫০ টাকা লাগে। অন্যদিকে ওএমএসের ট্রাকে ৩০০ লোকের জন্য চাল ও ৫০০ লোকের জন্য আটা থাকে। এক ব্যক্তি পাঁচ কেজি চাল ও চার কেজি আটা কিনতে পারেন। তাতে ব্যয় হয় ২৬০ টাকা, যা বাইরে থেকে কিনলে প্রায় ৫০০ টাকা লাগে।

ফ্যামিলি কার্ড চালুর পর থেকে আমরা ট্রাক সেল থেকে সরে এসেছি। কিন্তু রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে তা সীমিত সময়ের জন্য চালু করা হয়েছিল। আমাদের ভর্তুকির নির্দিষ্ট একটি পরিমাণ রয়েছে। এক কোটি পরিবারের ক্রয় ও বিতরণের জন্য লোকবল নিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হয়।
টিসিবির মুখপাত্র ও উপপরিচালক (বাণিজ্যিক) মো. শাহাদত হোসেন

বিপুল চাহিদা সত্ত্বেও টিসিবি কেন নিয়মিত ট্রাক সেল করছে না—এমন প্রশ্নের জবাবে টিসিবির মুখপাত্র ও উপপরিচালক (বাণিজ্যিক) মো. শাহাদত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্যামিলি কার্ড চালুর পর থেকে আমরা ট্রাক সেল থেকে সরে এসেছি। কিন্তু রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে তা সীমিত সময়ের জন্য চালু করা হয়েছিল। আমাদের ভর্তুকির নির্দিষ্ট একটি পরিমাণ রয়েছে। এক কোটি পরিবারের ক্রয় ও বিতরণের জন্য লোকবল নিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। সব মিলিয়ে এটা কত দিন চলবে বা আবার কবে শুরু হবে, সেটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বিষয়।’

ট্রাক সেলে ব্যাপক ভর্তুকি লাগে। ক্রয় আর বিক্রয়ের মধ্যে ২০ টাকা পার্থক্য থাকলেও হতো, কিন্তু আমাদের ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় অর্ধেক। আমাদের বাজেটের সীমাবদ্ধতা আছে, তাই চাহিদা থাকলেও সারা বছর এটা চালানো যায় না। তবে বিশেষ বিবেচনায় রমজানের আগে হয়তো আবার চালু করা হবে।
বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান

বিবিএসের তথ্য বলছে, গত আগস্ট মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। এই মূল্যস্ফীতির পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বা খাদ্যপণ্যের দাম।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি থাকলেও শহরে এমন কর্মসূচি নেই বললেই চলে। তাই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে যখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে, তখন স্বস্তি দেওয়ার জন্য ট্রাক সেল অব্যাহত রাখা উচিত। অনেক মধ্যবিত্তও টিসিবির লাইনে দাঁড়াচ্ছিল। তাই কম আয়ের মানুষের এলাকায় এটা চালু রাখা প্রয়োজন।

সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে এখন দারিদ্র্যের হার ২৭ দশমিক ৯৩ বা প্রায় ২৮ শতাংশ। সরকারি হিসাবে ২০২২ সালে এই হার ছিল ১৮ দশমিক ৭। আর একই সময়ে অতি দারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের ১৮ শতাংশ মানুষ রয়েছে অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। আর একটি পরিবারের মাসের মোট খরচের প্রায় ৫৫ শতাংশ চলে যায় খাবারের পেছনেই।

গ্রামে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি থাকলেও শহরে এমন কর্মসূচি নেই বললেই চলে। তাই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে যখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে, তখন স্বস্তি দেওয়ার জন্য ট্রাক সেল অব্যাহত রাখা উচিত। অনেক মধ্যবিত্তও টিসিবির লাইনে দাঁড়াচ্ছিল। তাই কম আয়ের মানুষের এলাকায় এটা চালু রাখা প্রয়োজন।
সিপিডি সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান

সবজির দাম বেশি থাকায় মানুষ বিকল্প হিসেবে ডিম খাওয়া বাড়িয়ে দেন। কিন্তু এখন ডিমের দামও বেড়েছে। বর্তমানে ফার্মের মুরগির এক ডজন ডিম ১৪০-১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাড়া-মহল্লায় দাম আরও কিছুটা বেশি। এ ছাড়া পাঙাশ ছাড়া অধিকাংশ মাছের কেজি ২০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ট্রাক সেলে ব্যাপক ভর্তুকি লাগে। ক্রয় আর বিক্রয়ের মধ্যে ২০ টাকা পার্থক্য থাকলেও হতো, কিন্তু আমাদের ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় অর্ধেক। আমাদের বাজেটের সীমাবদ্ধতা আছে, তাই চাহিদা থাকলেও সারা বছর এটা চালানো যায় না। তবে বিশেষ বিবেচনায় রমজানের আগে হয়তো আবার চালু করা হবে।’