দুই বছর মেগা প্রকল্প না নিতে সুপারিশ সাবেক প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমের

শামসুল আলমছবি: প্রথম আলো

আগামী দুই বছর কোনো মেগা প্রকল্প না নেওয়ার সুপারিশ করেছেন সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। বর্তমান অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা কমাতে ছয়টি সুপারিশ করেছেন তিনি। অন্য সুপারিশগুলো হলো কর ছাড় যৌক্তিক করা; বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশে মধ্যে রাখা; গড় শুল্ক-করহার ২০ শতাংশে নামানো; সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বিস্তৃত করা এবং বাজারসংকেত অনুসরণ জোরদার করা।

আজ শনিবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘অর্থনীতি: নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম এসব কথা বলেন। তিনি আগের সরকারে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। কারওয়ান বাজার প্রথম আলো কার্যালয়ে এই বৈঠক হয়। এতে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা অংশ নেন।

শামসুল আলম বলেন, ‘সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা চলছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত (রিজার্ভ), মূল্যস্ফীতি—এসব দিয়ে তা বুঝতে পারি। সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো অনেক দিন স্থিতিশীল ছিল। কোভিড মোকাবিলায় আমরা পারঙ্গমতা দেখিয়েছি। তখনো অর্থনীতি এমন অস্থিতিশীলতার মধ্যে পড়েনি। পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এল, এখন লোহিত সাগর ইস্যু এল—এসব কারণে অর্থনীতির স্থিতিশীলতার প্রশ্ন চলে আসছে। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে ১১টি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে। আগামী জুন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য অতি আশা বলা যায়। মনে হয় না, এই লক্ষ্য অর্জন হবে।’

মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণ প্রসঙ্গে শামসুল আলম আরও বলেন, প্রথমে দেখতে হবে কেন মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ার প্রথম কারণ ছিল বহিরাগত। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বারবার বাড়িয়েছে। ডলার যুক্তরাষ্ট্রমুখী হয়েছে। এতে ডলারের দাম বেড়েছে। বেশি দামে আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে মূল্যস্ফীতিও এসেছে। এরপর স্থানীয় বাজারে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিও তখন মূল্যস্ফীতিকে বেগবান করেছে। পরে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। উৎপাদন খরচ একবার বেড়ে গেলে রাতারাতি তা কমানো যাবে না। যে হারে উৎপাদন খরচ বেড়েছে, সে হারে খরচ কমে না। শুধু সুদহার দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

মুদ্রানীতি সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘মুদ্রা বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার জন্য অর্থনীতি এখন প্রস্তুত বলে মনে হয় না। কারণ, আমাদের আমদানি-রপ্তানি কাছাকাছি নয়। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের এক ভাগ রপ্তানি, দুই ভাগ আমদানি। মূল্যস্ফীতির এই কারণে এমন ভারসাম্যহীন অবস্থায় মুদ্রা বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। হঠাৎ করে যদি ডলারের দাম ১৩৫ টাকা হয়ে যায়, তাহলে অর্থনীতিতে আঘাত আসবে। মুদ্রানীতিতে যা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তা কিছুকাল চলতে দিতে হবে।’

শামসুল আলমের মতে, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে কলকারখানার কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, মধ্যবর্তী পণ্য—এসব নিয়ন্ত্রণ করছি কি না, তা দেখতে হবে। উৎপাদন কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা ঠিক নয়। এখন আমদানি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ কিছুটা শিথিল করা উচিত।’

শামসুল আলম আরও বলেন, ‘পুঁজি দেশে আসার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে কি না, দেখা উচিত। বিদেশ থেকে আসার সময় কারও কাছে ১০ হাজার ডলারের বেশি থাকলে বিমানবন্দরে ঘোষণা দিতে হবে কেন? দেশে ডলার আসাটাই এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রিজার্ভ বাড়াতে এই ধরনের নিয়ম শিথিল করা দরকার। এ দেশে পুঁজির নিরাপত্তা কম। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হওয়ার পর কানাডার বেগমপাড়ায় চলে যান। চাকরি শেষ, ছয় মাস পরে টরন্টো চলে যান তাঁরা। আবার সপ্তাহে দুবার ১০ লাখ টাকার বেশি লেনদেন হলেই বাংলাদেশ ব্যাংককে অবগত করতে হয়। কেন অবগত করতে হবে?’

শামসুল আলমের মতে, ‘হুন্ডি থামাতে পারছি না। প্রবাসী আয়ের ৫২ শতাংশ হুন্ডিতে আসে। এখন ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় আসছে। হুন্ডি বন্ধ হলে এর পরিমাণ ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার হয়ে যাবে। প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে সরকারি রেটে (১১০ টাকা) পাঠান না। যেখানে ১১৮ টাকা পান, সেখানেই চলে যান তাঁরা।’

সাবেক প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, গত দেড় বছরের ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ৩০ শতাংশ হয়েছে। রাজস্ব আদায় তো এমনিতে ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। যদি কর কমানো যেত, তাহলে মূল্যস্ফীতি কমানোয় বড় প্রভাব পড়ত। রাজস্ব আদায় শুধু সরকারের আয়ের দিকে থেকে চিন্তা করলে হবে না। উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে। অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়লে, ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হলে রাজস্ব আদায় এমনিতে বাড়বে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ৬৭ শতাংশ পরোক্ষ কর থেকে আসে। এটা প্রত্যক্ষ কর থেকে আসা উচিত।

বাজার প্রসঙ্গে শামসুল আলমের মত হলো, ‘বাজারসংকেত কাজ করছে না। বাজারে দরদাম ঠিক করে দিতে পারি না। বাজারে কোথাও সমস্যা হলে তাতে হস্তক্ষেপ করা যেতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, অর্থনীতিতে গণতন্ত্র বড় প্রশ্ন। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গণতন্ত্রের বিকল্প নেই।