এসি কি শুধু বিলাসিতা, নাকি প্রয়োজন

বিক্রেতারা বলছেন, প্রচণ্ড গরম এসির চাহিদা বাড়িয়েছে। দেশে উৎপাদিত হওয়ায় দাম কমেছে। একাংশের আয় বাড়ায় সামর্থ্য তৈরি হয়েছে।

দাবদাহে স্বস্তি দেয় এসিছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর উত্তরায় স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে বাস করেন ব্যবসায়ী মো. সাইদুর রহমান মৃধা। দোতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় বাস তাঁদের। গত বুধবার গরমে বাসায় টিকতে না পেরে রাত দেড়টা পর্যন্ত স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ছাদে কাটান তিনি।

রাজধানীর বাংলামোটরে ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান সিঙ্গারের বিক্রয়কেন্দ্র থেকে বৃহস্পতিবার কিস্তিতে দেড় টনের একটি হায়ার ব্র্যান্ডের শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) কেনেন সাইদুর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুরো ঘর দিনেও গরম থাকে, রাতেও গরম থাকে। মেঝে পর্যন্ত গরম হয়ে যায়।

সাইদুর আরও বলেন, ‘এসি কেনার ইচ্ছা ছিল না। কারণ, অনেক ধারদেনায় আছি। কিন্তু বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে খুবই কষ্টে কাটাতে হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে কিনলাম।’

রাজধানীতে গরম বাড়ছে। চলতি বছর রেকর্ডভাঙা গরম অনুভূত হচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, চলতি বছর তাপপ্রবাহ শুরু হয় ১ এপ্রিল। তার পর থেকে প্রায় পুরো মাস দেশের বিভিন্ন অঞ্চলজুড়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, যা ৭৬ বছরের মধ্যে দেখা যায়নি। এমন প্রচণ্ড গরমে ঘরে-বাইরে থাকা কঠিন হয়ে গেছে। রাতেও ঘর ঠান্ডা হচ্ছে না। প্রচণ্ড গরমে ঘুমে ব্যাঘাতসহ কেউ কেউ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

ঢাকায় যে তাপমাত্রা থাকে, তার চেয়ে কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি গরম অনুভূত হয়। ভবনের তাপ ধরে রাখা; গাছপালা ও জলাশয় কম থাকা; অল্প জায়গায় বেশি মানুষ ও যানবাহন থাকা; নানা ধরনের দূষণসহ বেশ কিছু কারণ এর পেছনে রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এ রকম অবস্থায় গরম থেকে বাঁচতে সাইদুর রহমানের মতো বহু মানুষ এসি কিনছেন। বিগত কয়েক দিনে রাজধানীর কয়েকটি ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বিক্রির দোকান ঘুরে ও মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মধ্যম আয়ের মানুষ ও নির্দিষ্ট আয়ের চাকরিজীবীরা এসি কিনছেন মূলত তিনটি কারণে—এক. প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ হয়ে এসি কেনা ছাড়া উপায় থাকছে না। দুই. শিশু ও প্রবীণদের কথা চিন্তা করে কোনো কোনো পরিবার এসি কিনছে। তিন. প্রতিবেশী ও স্বজনেরা এসি কেনায় কোনো কোনো পরিবার তা কিনতে উৎসাহিত হচ্ছে।

কেউ কেউ বাইরের ধুলাবালু থেকে মুক্ত থাকতেও এসি কিনছেন। এমন একজন রাজধানীর তেজগাঁওয়ের তেজতুরী বাজার এলাকার বাসিন্দা আলী আহমেদ। শুক্রবার সকালে তিনি কারওয়ান বাজারের ট্রান্সকম ডিজিটালের বিক্রয়কেন্দ্রে এসি কিনতে যান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার বাসায় যে পরিমাণ ধুলাবালু, তাতে নির্মল বায়ু পাওয়াও কঠিন। তিনি থাকেন ছয়তলায়, যেটি সবচেয়ে ওপরের তলা (টপ ফ্লোর)। ব্যাপক গরম। সব মিলিয়েই তিনি এসি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

রাজধানীর ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবনের ওপরের দিকে গরম বেশি থাকে। ফলে ভবনের মাঝামাঝি থেকে ওপরের তলায় বসবাসকারীরা বেশি এসি কিনছেন।

কেউ কেউ মনে করেন, দেশের মানুষের একটি বড় অংশের ক্রয়ক্ষমতাও আগের চেয়ে বেড়েছে, যা এসির বাজার বড় হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।

বিশ্বব্যাংকের তালিকায় বাংলাদেশ ২০১৫ সালে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের শ্রেণিতে স্থান পায়। যাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৫ ডলার বা তার নিচে, তাদের বলা হয় নিম্ন আয়ের দেশ। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে এ তালিকাতেই ছিল। মূলত ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে শুরু করে যেসব দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার, তারা মধ্যম আয়ের দেশের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে আবার আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে শুরু করে ৪ হাজার ১২৫ পর্যন্ত হলে তা হবে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ।

বাংলাদেশ এখন জাতিসংঘের তালিকায় স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের অপেক্ষায়।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৬৫ ডলারে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, মাথাপিছু আয় দুই হাজার ডলার ছাড়ালে একটি দেশে ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, গাড়ি, মোটরসাইকেল ইত্যাদির চাহিদা বাড়ে।

এসি বিক্রেতারা বলছেন, আয় বাড়ার পাশাপাশি তাপপ্রবাহ এসির চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজধানীতে এসির বিক্রি যেমন ব্যাপকভাবে বেড়েছে, তেমনি বড় শহর ও উপজেলা শহরেও বিক্রি বাড়ছে।

এলিট হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূর এ আলম প্রথম আলোকে বলেন, দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার উন্নতির জন্য জনগণের একটা বড় অংশ এখন এসি কিনতে পারছে। তা ছাড়া বাংলাদেশে বিগত ১০ বছরে মানসম্পন্ন এসির দাম ধারাবাহিকভাবে কমেছে। এর কারণ দেশে উৎপাদন।