পরিবর্তন আসছে বিশ্বব্যাংকে, সংস্কার হয়েছে এডিবিতে—তাৎপর্য কী

বড় ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হচ্ছে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর। এসব সংস্কারের মধ্য দিয়ে তাদের কাজের আওতা বাড়বে। তারা আরও বেশি অর্থও ছাড় করতে পারবে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, এতে উন্নয়নশীল দেশগুলো উপকৃত হবে।

আগামী সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক বৈঠকে সদস্যদেশগুলোর অর্থমন্ত্রীরা সংস্থাটির সংস্কার প্রস্তাব অনুমোদন করবেন বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ইতিমধ্যেই বেশ কিছু সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে ফেলেছে।

টাইমস নিউজ নেটওয়ার্ক বা টিএনএনের সূত্রে টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, বিশ্বব্যাংকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ৮০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান দারিদ্র্য বিমোচন থেকে বেরিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ‘বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়’ সহায়তা করবে—এই হচ্ছে সংস্কারের মূল কথা। এই পরিবর্তন আনতে আগামী সপ্তাহে মরক্কোর মারাকেশে অনুষ্ঠেয় বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির সদস্যদেশগুলোর কাছে অনুমোদন চাওয়া হবে।

এদিকে পুঁজি ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সংস্কার এনেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। এই সংস্কারের কারণে আগামী এক দশকে ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলারের নতুন বিনিয়োগ তহবিল ছাড় করতে পারবে সংস্থাটি। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উন্নয়নে এই অর্থ বিনিয়োগ করা হবে।

এ ছাড়া এই সংস্কারের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান তহবিলের সম্প্রসারণ সহজতর হবে। অভ্যন্তরীণ পুঁজি সংগ্রহের মধ্য দিয়ে এসব তহবিলের আকার ট্রিলিয়ন ডলার বা লাখো কোটি ডলারে উন্নীত করা হবে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় এই তহবিল ব্যবহার করা হবে।

বিশ্বব্যাংকের ভাবনায় পরিবর্তন

সম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত জি–২০ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে একমত হয়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত অজয় বাঙ্গা বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ধারণা করা হয়েছিল, বৈশ্বিক এই সংস্থায় পরিবর্তন আসবে, এবার তা হতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের উদ্যোগী ভূমিকা আছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা গেছে।

ভারত এই বিষয়ে স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে। তাদের প্রথম সুপারিশগুলো নিয়ে এখন আলোচনা করা হচ্ছে, যার মধ্যে আছে বহুপক্ষীয় উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে আরও পুঁজি জোগানো। এই কমিটি ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণের কাছে ‘বিগার, বেটার, বোল্ডার’ শীর্ষক প্রতিবেদন দাখিল করেছে। সেখানে কীভাবে আরও ব্যক্তি খাতের পুঁজি জোগাড় করা যায়, এমন ভাবনা থেকে শুরু করে বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর দক্ষতা উন্নয়নের কথাও বলা হয়েছে। মারাকেশে এসব বিষয়ে আলোচনা হবে। অজয় বাঙ্গা নিজে বেসরকারি খাতের মানুষ হওয়ায় বেসরকারি খাতের পুঁজি সংগ্রহের বিষয়টি গতি পাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের নতুন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হতে পারে এ রকম—দারিদ্র্য বিমোচন, অভিন্ন সমৃদ্ধি, অন্তর্ভুক্তি, ঘুরে দাঁড়ানো ও ধারাবাহিকতা।

‘বিগার, বেটার ও বোল্ডার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে যেসব চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হলো—জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মহামারি প্রতিরোধ ও প্রস্তুতি, জ্বালানিপ্রাপ্তি, খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা, পানির নিরাপত্তা ও প্রাপ্যতা, ডিজিটাইজেশন নিশ্চিতকরণ,জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতির সুরক্ষা।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অর্থায়নের যে ধারণা প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে, তা এ রকম—এসডিজি বাস্তবায়নে বার্ষিক অতিরিক্ত ৫০০ বিলিয়ন বা ৫০ হাজার কোটি ডলার ব্যয়; জলবায়ু, দ্বন্দ্ব–সংঘাত ও মহামারি মোকাবিলায় বার্ষিক ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার; ২০৩০ সাল পর্যন্ত বার্ষিক অতিরিক্ত ৩ লাখ কোটি ডলার বিনিয়োগ; কপ ২৭ অনুযায়ী ২০৩০ সাল পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বার্ষিক ৪ থেকে ৬ লাখ কোটি ডলার বিনিয়োগ।

এডিবিতে যা হয়েছে

এডিবির যে কাঠামোগত সংস্কার করা হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে সংস্থাটির বার্ষিক অর্থায়নের প্রতিশ্রুতির সক্ষমতা ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তারা এখন বছরে ৩৬ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থায়নের অঙ্গীকার করতে পারবে। সংস্থাটির পুঁজি ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই তা করা হবে বলে এডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

এ ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে উন্নয়নশীল সদস্যদেশগুলোকে আগামী এক দশকে ৩৬০ বিলিয়ন বা ৩৬ হাজার কোটি ডলারের সহায়তা দেবে এডিবি। লক্ষ্য হচ্ছে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উন্নয়নে স্বল্প সুদে ও দীর্ঘ মেয়াদে অর্থ দেওয়া।

উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে বেসরকারি পুঁজি সংগ্রহে জোর দিচ্ছে এডিবি। উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে এডিবি বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করতে চায়। বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়নের সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণের কাঠামো তৈরি—এসব ক্ষেত্রেও কাজ করতে আগ্রহী এডিবি।

বিশ্বায়ন ও বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান

বিশ্বায়নব্যবস্থা ও বহুপক্ষীয় সংস্থাগুলো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না, এমন অভিযোগ এখন আর কেবল উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে উঠছে, তা নয়; খোদ উন্নত দেশগুলো থেকেও আসছে।

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালের রীতিতে চলছে। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বা প্রধান হবেন একজন মার্কিন নাগরিক (বর্তমান প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা মার্কিন-ভারতীয়) আর আইএমএফের প্রধান বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক হবেন একজন ইউরোপীয়।

এই পরিস্থিতিতে বিশ্বায়নব্যবস্থা সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎস। ‘মেকিং গ্লোবালাইজেশন ওয়ার্ক’ শীর্ষক বইয়ে তিনি বেশ কিছু সংস্কারের প্রস্তাব দেন। এ ক্ষেত্রে মূলত তিনি আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কথাই বলেন। আইএমএফে যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ, যার কার্যকর ভেটো প্রদানের ক্ষমতা আছে।

এই দুই প্রতিষ্ঠানেই সদস্যদের ভোট প্রদানের ক্ষমতা অর্থনৈতিক শক্তির ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। তা–ও সেটা আজকের যুগের অর্থনৈতিক শক্তির ভিত্তিতে নয়, তাদের প্রতিষ্ঠাকালীন আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে। এতে পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে করেন জোসেফ স্টিগলিৎস। এ ছাড়া তিনি প্রতিনিধিত্বের ধরন ও নীতিতেও পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দিয়েছেন। দ্বন্দ্ব নিরসনের পদ্ধতিও উন্নত করার প্রস্তাব দেন তিনি। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আরও উন্মুক্ত করার পক্ষপাতী এই নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ।