দরপতন ঠেকাতে শেয়ারবাজারের মতো ফ্লোর প্রাইস চায়ের দামে

চা–বাগানফাইল ছবি

শেয়ারবাজারের মতো চায়ের নিলামেও দরপতন চলছে। সদ্য শেষ হওয়া ২০২৩–২৪ মৌসুমের সাপ্তাহিক নিলামগুলোয় ধারাবাহিকভাবে চায়ের দরপতন হয়। চলতি মাসের প্রথম দিন অনুষ্ঠিত সাপ্তাহিক নিলামে প্রতি কেজি চা গড়ে বিক্রি হয়েছে ৭৭ টাকা ৬৮ পয়সায়। এ অবস্থায় আগামীকাল সোমবার চট্টগ্রাম নিলাম কেন্দ্রে ২০২৪–২৫ মৌসুমের নিলাম শুরু হচ্ছে। এবার শেয়ারবাজারের মতো ‘ফ্লোরপ্রাইস’ বা ন্যূনতম নিলাম মূল্য বেঁধে দরপতন ঠেকানোর পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে চায় চা বোর্ড।

চা বেচাকেনায় যুক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, ন্যূনতম নিলাম মূল্যে চা উৎপাদকদের ভালো দাম পাওয়ার সুযোগ আছে। আবার সাধারণ ও নিম্নমানের চা বিক্রি না হওয়ার আশঙ্কা আছে। নিলামে ক্রেতাদের কেমন সাড়া পড়বে, তার ওপর নির্ভর করবে এই উদ্যোগ কতটুকু কার্যকর।

জানতে চাইলে চা–বাগানের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কামরান টি রহমান আজ রোববার প্রথম আলোকে বলেন, চা–শিল্পকে বাঁচাতে উৎপাদক, ক্রেতা, ব্রোকার্সসহ সবাই মিলে ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে চা–শিল্পের জন্যই ইতিবাচক হবে।

চা এমন একটি পণ্য, যেটি নিলামে তুলে বিক্রি করতে হয় উৎপাদকদের। সাধারণত বাগানমালিকেরা বাগান থেকে পাতা তুলে চা তৈরির পর তা গুদামে পাঠান। ব্রোকার্স প্রতিষ্ঠানগুলো সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। নমুনা অনুযায়ী চায়ের মান নির্ধারণ করে তারা। এরপর প্রতি সপ্তাহে নিলামে সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে চা বিক্রি করা হয়।

লট অনুযায়ী সর্বোচ্চ দরদাতারা কর পরিশোধ করে গুদাম থেকে চা তুলে নেন। এর বাইরে বাগানমালিকেরা চাইলে নিজস্ব বাগানের উৎপাদিত চায়ের ২৫ শতাংশ নির্ধারিত পরিমাণ কর দিয়ে প্যাকেটজাত করতে পারেন। চট্টগ্রাম, শ্রীমঙ্গল ও পঞ্চগড়ে চায়ের নিলাম অনুষ্ঠিত হয়।

যে কারণে ফ্লোর প্রাইস

গত বছর দেশের ১৬৮টি বাগান ও ক্ষুদ্রায়তন চা–চাষিদের হাত ধরে ১০ কোটি ২৯ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়। চা চাষের ১৮৪ বছরের ইতিহাসে এই উৎপাদন ছিল সর্বোচ্চ। তবে উৎপাদনে এমন সুখবর চা–বাগানমালিকদের জন্য উল্টো দুঃসংবাদ হয়ে এসেছে নিলাম দরে। গত মৌসুমে চট্টগ্রাম, শ্রীমঙ্গল ও পঞ্চগড়ে মোট ৮৯টি নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে সিংহভাগ চা বিক্রি হয় চট্টগ্রামের নিলামে। ৮ এপ্রিল চট্টগ্রামে শেষ নিলামের মাধ্যমে ২০২৩–২৪ মৌসুমের নিলাম শেষ হয়েছে।

চট্টগ্রামের নিলামে দেখা যায়, প্রথম নিলামে চায়ের কেজিপ্রতি দর ওঠে ২৪৯ টাকা ২৪ পয়সা। শুরুর দিকে দর ভালো থাকলেও তা বেশি দিন টেকেনি। শুরু হয় ধারাবাহিক দরপতন। তাতে কেজিপ্রতি চায়ের গড় দাম ১০০ টাকার নিচে নেমে আসে ৪৬তম নিলামে। নিলামে কেজিপ্রতি চায়ের গড়মূল্য দাঁড়ায় ৯৮ টাকায়। শেষ ৪৯তম নিলামে এ দাম আরও কমে নেমে আসে ৭৭ টাকা ৬৮ পয়সায়। সব মিলিয়ে ৪৯টি নিলামে চায়ের কেজিপ্রতি গড় দাম ছিল ১৭২ টাকা, যা এর আগের মৌসুমের নিলামের চেয়ে কেজিপ্রতি ২৪ টাকা কম।

চা বেচাকেনায় যুক্ত ব্যবসায়ীরা জানান, চায়ের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি। আবার সমতলের চায়ের মান ভালো ছিল না। এ রকম পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই চায়ের দরপতন হতে থাকে। উৎপাদন খরচের চেয়ে চায়ের গড় দাম কমে যাওয়ায় বাগানমালিকেরা হতাশ হয়ে পড়েন। এ পরিস্থিতিতে গত ৬ মার্চ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে চায়ের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। এরপর চা বোর্ডের নেতৃত্বে চা উৎপাদন ও বেচাকেনায় যুক্ত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ১১ সদস্যের একটি কমিটি চায়ের নিলামে ন্যূনতম দাম বা ফ্লোর প্রাইসের সুপারিশ করেছে। ২৪ এপ্রিল এই সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়েছেন উৎপাদক ও ক্রেতারা।

চায়ের লিকারের ওপর ভিত্তি করে ছয় ধাপে ন্যূনতম মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হয়েছে। বাগানমালিকেরা ব্রোকার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে চায়ের নমুনা পাঠানোর পর তারা লিকার রেটিং করবে। সবচেয়ে সাধারণ মানের চায়ের ন্যূনতম মূল্য হবে ১৬০ টাকা। এর চেয়ে ভালো মানের চায়ের ন্যূনতম মূল্য হবে যথাক্রমে ২১০, ২২৭, ২৪৫ ও ২৭০ টাকা। সবচেয়ে ভালো মানের চায়ের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০০ টাকা।

চা ব্যবসায়ীরা জানান, ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ কমিটি নিম্নমানের চা নিলামে না তোলার যে সুপারিশ করেছে, তা ইতিবাচক। তবে মাঝারি মানের যে চায়ের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটির সফলতা নির্ভর করবে ক্রেতারা কতটা সাড়া দিচ্ছেন, তার ওপর।