বঙ্গবাজারের দরজিরাও এবারের ঈদে আয় করতে পারেননি
ঢাকার বঙ্গবাজারকেন্দ্রিক পাইকারি পোশাক ব্যবসাকে ঘিরে কাটিং-ফিটিংয়ের কাজও বেশ জমে উঠেছিল। দরজিরা মার্কেটগুলোর এখানে–ওখানে সেলাই মেশিন নিয়ে বসতেন। এ জন্য অবশ্য হাতে গোনা কয়েকটি দোকানঘরও ছিল। ৪ এপ্রিল সকালে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পোশাক ব্যবসায়ীদের মতো দরজিরাও নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। কারণ, তাঁদেরও বিভিন্ন মালামাল পুড়ে গেছে।
ঈদ সামনে রেখে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের অস্থায়ীভাবে চৌকিতে বসে দোকান করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ক্রেতারা যেন ওই এলাকা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তাঁরা আগের মতো আসেননি। ফলে পোশাক ব্যবসা জমেনি। পোশাক ব্যবসা না জমায় দরজিরাও তেমন কাজ পাননি। যে কারণে তাঁরা এবারের ঈদে চলার মতো আয়রোজগার করতে পারেননি।
গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে দেখা গেছে, বঙ্গবাজারের পোড়া মার্কেটের খোলা জায়গায় যেখানে অস্থায়ীভাবে ব্যবসায়ীরা দোকান করছেন, তার আশপাশে অনেক দরজিও ছাতার নিচে সেলাই মেশিন নিয়ে বসেছেন। তাঁরা মূলত ৫০–১০০ টাকার বিনিময়ে শার্ট–প্যান্টের কাটিং–ফিটিং করে দেন। সেই সঙ্গে জামা–প্যান্টের বোতাম, চেইন, হুক লাগানোর কাজ করেন। পুরোনো ছেঁড়া কাপড়ও সেলাই করে দেন তাঁরা। এসব দরজি বলছেন, অন্যান্য বছর ঈদের আগে কাজের খুব চাপ থাকত। অনেক সময় কাজ নিয়ে আসা ব্যক্তিদের সারিতে দাঁড়িয়েও অপেক্ষা করতে হতো। এবার উল্টো তাঁরা কাজ পাওয়ার আশায় বসে থাকলেও তা তেমন পাননি।
বঙ্গবাজারে ২১ বছর ধরে দরজির কাজ করেন মুন্সিগঞ্জের আবদুল কালাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবছর ঈদের কেনাকাটা শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় হতো। বছরের এই একটা সময় যখন আমাদের আয় হতো, সবচেয়ে বেশি। এবার অগ্নিকাণ্ডের কারণে কয়েক দিন সেলাই মেশিন নিয়ে বসতে পারিনি। এখন বসতে পারলেও মার্কেটে যেহেতু ক্রেতা নেই, সেহেতু আমাদেরও কাজ নেই।’
আরও কয়েকজন দরজির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য-পরিসংখ্যান না থাকলেও আনুমানিক ২৫০ থেকে ৩০০ দরজি বঙ্গবাজারের বিভিন্ন মার্কেটে কাজ করতেন। এসব দরজির অধিকাংশই দোকানের পাশে বা মার্কেটের বিভিন্ন স্থানে ছোট জায়গা নিয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে বসতেন। তাঁরা মূলত নতুন পোশাক কেটে ছোট করে দেওয়া বা পুরোনো পোশাক সেলাইয়ের কাজ করতেন। আবার বঙ্গবাজারে স্থায়ী দোকান নিয়ে বিভিন্ন ধরনের নতুন কাপড় সেলাইয়ের কাজ করতেন কিছু দরজি।
এবার ঈদ উপলক্ষে আয় কম হওয়ায় এসব দরজির অনেকেই বাড়ি যাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন। ঈদের এক দিন আগে এনেক্সকো মার্কেটের পাশে বসা মাদারীপুরের আক্তার হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, দুপুর পর্যন্ত ৪০০ টাকার কাজ হয়েছে। অন্য বছর এ সময়ে কাজের জন্য দম ফেলা যেত না। আয় কমে যাওয়ায় বাড়ি যেতে ইচ্ছা করছে না। কারণ, এ সময়ে গেলে সবার জন্য কিছু না কিছু নিতে হয়। আয় ভালো না হওয়ায় সেই সুযোগ নেই।
৪ এপ্রিল বঙ্গবাজার আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরে এ মার্কেট থাকে মুখ ফিরিয়ে নেন ক্রেতারা। ঈদের আগে খোলা মাঠের নিচে অস্থায়ীভাবে বসলেও ক্রেতারা গরমের মধ্যে এ মার্কেটে আসেননি। তাতে বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারেননি। যে কারণে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি দোকান কর্মচারীদের বেতন-বোনাস পরিশোধ নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা গেছে। একইভাবে বিভিন্ন মার্কেটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দরজিরাও ঈদের আগে তেমন কাজ পাননি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বঙ্গবাজারে ৩ হাজার ৮৪৫টি দোকানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যাতে সব মিলিয়ে ৩০৩ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে মালপত্রের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২৮৮ কোটি টাকার বেশি। আর মার্কেটগুলোর কাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ ছাড়া দোকানের মালিক-কর্মচারীদের মানবিক ও মানসিক বিপর্যয়জনিত ক্ষতির পরিমাণ এবং চাকরিহীনতার আর্থিক মাপকাঠি নিরূপণ করা দুরূহ বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।