ভঙ্গুর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা টেকসই উন্নয়নে বাধা

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ স্মরণে আয়োজিত স্মারকবক্তৃতা অনুষ্ঠানে অতিথিরা। আজ শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য শক্তিশালী ও কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। পশ্চিমা ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মূলে রয়েছে এই প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি। আর মানব উন্নয়নকে বাদ দিয়ে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আবার একটি দেশের অর্থনৈতিক ফলাফল পর্যালোচনা করতে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিশ্লেষণ হওয়া উচিত।

আজ শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এসব কথা বলেন। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ স্মৃতি সংসদ ও রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট যৌথভাবে এই স্মরণসভার আয়োজন করে।

স্মরণসভায় ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ, রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও জনসমাজ’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে দেওয়া–নেওয়ার একটি সম্পর্ক তৈরি হয়। এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্কের বিনির্মাণই হলো রাষ্ট্রের বিনির্মাণ। আর রাষ্ট্র নির্মিত হওয়ার পর সেটি কার্যকর হওয়ার জন্য ভোটারের হাতে ক্ষমতা থাকা আবশ্যক। যদিও ক্ষমতা ক্রমাগত কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এদিকে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি শাস্ত্রে প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। ভঙ্গুর ও অকার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে।

তিনি পুরোপুরি মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক ছিলেন না, আবার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকেও পুরোপুরি ধারণ করেননি। তিনি আমাদের বুঝিয়েছেন যে মানব উন্নয়ন বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়।
— এম এম আকাশ, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ভিন্নমত ছাড়া সমাজ হয় না উল্লেখ করে রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, একদিকে রাষ্ট্র সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না, ন্যায়বিচার প্রলম্বিত হচ্ছে। অন্যদিকে দেশ পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ভিন্নমতকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার জন্য আইন তৈরি করা হচ্ছে। ভিন্নমত কেবল একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অতীব প্রয়োজনই নয়, একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্যও ভিন্নমত অধিকতর দরকারি শর্ত।

রাশেদ আল মাহমুদ আরও বলেন, রাজনীতি চালিত হয় পুঁজিকে কেন্দ্র করে, অর্থাৎ ক্ষমতা, শ্রেণি, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় ক্ষমতার মাধ্যমে, এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর মধ্যেই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক চেহারা বিরাজমান। রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হলো ক্ষমতার বণ্টন। এর সঙ্গে শ্রেণি জড়িত।

সামাজিক সুরক্ষা নীতির আওতায় নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে লক্ষ্য করে নেওয়ার ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে বৈষম্য দূর করতে সক্ষম হচ্ছে না উল্লেখ করে স্মারক বক্তৃতায় বলা হয়, এই ব্যবস্থা সর্বজনীন নয়। অথচ নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলোয় সবার সমান ও সর্বজনীন সুযোগ থাকার কথা। বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সামাজিক নিরাপত্তা জালের বদলে সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রণয়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ‘দেশে কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র চলছে। নাগরিক আন্দোলনে যোগ দিয়ে মানুষের কথা বলতেন, আবার যখন মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলার কেউ থাকত না, তখন একা একটা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে মোজাফফর আহমদ দাঁড়িয়ে যেতেন। অর্থনীতি তো বটেই, দেশের নাগরিক উন্নয়নের জন্যও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি পুরোপুরি মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক ছিলেন না, আবার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকেও পুরোপুরি ধারণ করেননি। তিনি আমাদের বুঝিয়েছেন যে মানব উন্নয়ন বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়।’

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম এ সাত্তার মণ্ডল বলেন, ‘এই মানুষটি যেকোনো বিষয় ভাবতে ভালোবাসতেন। অন্যকে সেটা জানানোর জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতেন। একবার এক স্মরণসভায় মোজাফফর আহমদকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তিনি সেখানে মুক্তবাজার অর্থনীতির এপিঠ-ওপিঠ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। আমাদের মনে হয়েছিল, তাঁর পড়াশোনা ও জানাশোনার গভীরতা অনেক বেশি। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন না। তবে নব্বইয়ের দশকের পর থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত একসঙ্গে অনেক সময় পার করেছি। অনেক বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হতো। কত বিষয় নিয়ে বিতর্ক করেছি। তিনি সব সময় সেগুলো মন দিয়ে শুনতেন, গুরুত্ব দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতেন। আজ যে অন্যায়, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনা চলছে—এই সময় যদি স্যার বেঁচে থাকতেন, তাহলে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারতাম। তথ্য অধিকার আইন নিয়ে কাজ করার সময় দেখেছি, অর্থনীতির কাঠখোট্টা বিষয়ের বাইরেও তিনি নাগরিক অধিকার নিয়ে কথা বলতেন।’

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের সহধর্মিণী রওশন জাহান। তিনি এই আয়োজনের জন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন মোজাফফর আহমেদ স্মৃতি সংসদের সদস্যসচিব বিধান চন্দ্র পাল, রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের সভাপতি আরিফ খান।