যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়াতে এগিয়ে এলেন ব্যবসায়ীরা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পফাইল ছবি: এএফপি

বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে শেষ পর্যন্ত ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন। গত বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসের এ–সংক্রান্ত ঘোষণার আগে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে শুল্ক কমানোর বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করেছে। পাশাপাশি একই ইস্যুতে সরকারি দলের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র সফররত বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারাও দুই দেশের বাণিজ্যঘাটতি কমিয়ে আনতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন। এসব উদ্যোক্তা পণ্য আমদানি বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে সমঝোতা ও অঙ্গীকার করেছেন। সরকারি–বেসরকারি খাতের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশি পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক হার কমিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন।

বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সফরে থাকা ব্যবসায়ীদের দলে রয়েছেন মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল, এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আমীরুল হক, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, বিটিএমএর পরিচালক মোশাররফ হোসেন ও মাসুদ রানা, সালমা গ্রুপের পরিচালক চৌধুরী মোহাম্মদ হানিফ শোয়েব।

জানা গেছে, পাল্টা শুল্ক কমাতে বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দপ্তরের সঙ্গে দর–কষাকষি করছে। শুরু থেকে এ কাজে এমন ব্যক্তিদের পাঠানো হয়েছে, যাঁরা আলোচনাকে একটা পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেননি। জুলাইয়ে দ্বিতীয় দফা আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আগে নেতৃত্বে আসেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। ব্যবসায়ী নেতারা প্রথম থেকে দর-কষাকষির প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের যুক্ত করার অনুরোধ করেন। একেবারে শেষ সময়ে এসে সরকার ব্যবসায়ীদের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে।

সরকারের আহ্বানে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর গত বুধ ও বৃহস্পতিবার—এই দুই দিন ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল দফায় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এসব সভায় তাৎক্ষণিকভাবে ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সয়াবিনবীজ ও তুলা আমদানির সমঝোতা চুক্তি করেছেন তাঁরা। আবার বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দফায় দফায় আলোচনার পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় চার লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির তাৎক্ষণিক সমঝোতা হয়েছে। মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ১৩ কোটি মার্কিন ডলারের তিন লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির সমঝোতা করেছেন। ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রায় ১০ কোটি ডলারের সয়াবিনবীজ আমদানির সমঝোতা করেছেন। সয়াবিন তেল ও প্রাণিখাদ্য তৈরির কাঁচামাল হলো সয়াবিন বীজ।

জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন থেকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিযোগিতামূলক দাম পাওয়ার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে একটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সয়াবিনবীজ আমদানির সমঝোতা চুক্তি করেছি। এ ছাড়া ভুট্টা, এলপিজি, গম আমদানি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছি আমরা। বাণিজ্যঘাটতি হ্রাস করার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক কমানোর জন্যই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে স্ক্র্যাপ বা পুরোনো লোহার টুকরা, সয়াবিনবীজ, তুলা ও এলপিজি—এই চার পণ্য আমদানি হয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি ডলারের, যা মোট আমদানির ৬০ শতাংশ। আবার গত অর্থবছর বাংলাদেশে এই চার পণ্যের মোট আমদানি ছিল ৭৪০ কোটি ডলারের। সেই হিসাবে এই চার পণ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হচ্ছে মোট আমদানির ২০ শতাংশ। তাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসব পণ্যের আমদানি বাড়ানো সম্ভব বলে ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

জানা যায়, সয়াবিনবীজ ছাড়াও তুলা আমদানির সমঝোতা চুক্তি করেছেন যুক্তরাষ্ট্র সফররত বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরা। ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ১৯ হাজার টন তুলা আমদানির সমঝোতা চুক্তি করেছেন বস্ত্র খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে সালমা গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্রের কার্গিল ইনকরপোরেটের কাছ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ ডলারের ৬ হাজার টন তুলা আমদানির চুক্তি করেছে। এশিয়া কম্পোজিট একই রকম আরেকটি চুক্তি করে। এ ছাড়া মোশাররফ গ্রুপ মার্কিন লুইস ড্রেফুস গ্রুপ থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ৭ হাজার টন তুলা আমদানির চুক্তি করেছে।

জানতে চাইলে বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক বিলিয়ন বা এক শ কোটি ডলারের তুলা আমদানির অঙ্গীকার করেছি আমরা। আবার যুক্তরাষ্ট্রের তুলা ব্যবহার করে রপ্তানি করলে যাতে রপ্তানিতে সুবিধা পাওয়া যায়, সেটিও জানিয়েছি আমরা। তাহলে তুলা আমদানি আরও বাড়বে। উভয় দেশ লাভবান হবে।’

মোশাররফ কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘তুলা আমদানির জন্য যে সমঝোতা চুক্তি আমরা করেছি, সেই অনুযায়ী ওই সব তুলা আগামী ছয় মাসের মধ্যে আমদানি করা হবে। এ জন্য আমরা বাণিজ্য উপদেষ্টার কাছ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ সহায়তা চেয়েছি।’

বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির একক বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। এনবিআরের হিসাবে, গত অর্থবছরে দেশটিতে ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে প্রায় ৮৭ শতাংশ বা ৭৫৯ কোটি ডলারই ছিল তৈরি পোশাক। তার বিপরীতে একই সময়ে বাংলাদেশ ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকায় ২ এপ্রিল ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা এখন কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি কমলে এই হার সামনে আরও কমানোর সুযোগ আছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

জানতে চাইলে ওয়াশিংটন থেকে এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলওএবি) সভাপতি আমীরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে অনেকগুলো সমঝোতা হয়েছে। সমঝোতা ও অঙ্গীকার অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি এক বছরেই ৭৫ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য বাংলাদেশ সরকারের নীতি–সহায়তা দরকার। ব্যবসা সহজীকরণ করা দরকার। যেমন এলপিজি আমদানিতে বন্দরকেন্দ্রিক সমস্যা দূর করা এবং সয়াবিনবীজ থেকে তৈরি সয়ামিলের আমদানিতে শুল্ক আরোপ করা হলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি আরও বাড়বে।