লুণ্ঠিত ঋণকে খেলাপি থেকে আলাদা করা প্রয়োজন
দেশের ব্যাংক খাত থেকে লুণ্ঠিত অর্থ তথা বেনামি ঋণকে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ থেকে আলাদা করার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা। তাঁরা বলেছেন, বেনামি ঋণ বন্ধ করতে হবে। এ ধরনের ঋণের দায় অন্য সবার ওপরে দিলে অর্থনীতি এগোবে না।
আজ শনিবার ‘অর্থনীতি: নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ’ বিষয়ে প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ছিলেন সাবেক একজন প্রতিমন্ত্রী, পাঁচজন অর্থনীতিবিদ, দুজন ব্যবসায়ী ও একজন সাবেক ব্যাংকার। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন।
গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মো. আলী খোকন বলেন, খেলাপি ঋণের আলোচনায় মন্দ ঋণের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আপনারা মন্দ ঋণকে বেনামি ঋণের থেকে আলাদা করুন। বেনামি ঋণের ভার আমরা ব্যবসায়ীরা কেন নেব। হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক ও পি কে হালদারের দায়ভার কি আমরা নেব? বাংলাদেশ ব্যাংক কি ঘুমিয়েছিল? বেনামি ঋণকে বের করে তারপর সত্যিকারের খেলাপি ঋণ কত, সেটি নিয়ে আলোচনা করা উচিত।
ব্যবসায়ী মো. আলী খোকনের বক্তব্যে সমর্থন জানিয়ে সভায় ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক মঈনউদ্দীন বলেন, খেলাপি ঋণ থেকে বেনামি ঋণকে আলাদা করা প্রয়োজন।
গোলটেবিল বৈঠকে নতুন সরকারের সামনে মূল্যস্ফীতিকে অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন বক্তারা। এর পাশাপাশি জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের সংকট দূর করা, অর্থ পাচার রোধ করা, প্রবাসী আয় ও রিজার্ভ বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া এবং সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন তাঁরা।
বৈঠকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, নতুন সরকারকে স্বল্প মেয়াদে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতি ও সামস্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে সুদহার আরও বাড়ানোর মাধ্যমে। সুদহার বাড়ালে ডলারের বিনিময় হারেও স্থিতিশীলতা ফিরবে। ব্যাংকের তারল্যসংকটেরও সমাধান হয়ে যাবে। বাইরে থাকা টাকা ব্যাংকে ফিরে আসবে। পাশাপাশি আমানতকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোতে যা চলছে, তা বন্ধ করতে হবে।
আগামী জুন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যকে ‘অতি আশা’ বলে মনে করেন সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। তিনি বলেন, মনে হয় না, এই লক্ষ্য অর্জিত হবে। দেশে চলমান মূল্যস্ফীতি প্রথমত আমদানির সঙ্গে এসেছে, অর্থাৎ এটা ছিল বহিরাগত। পরে উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধিজনিত কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। উৎপাদন খরচ একবার বেড়ে গেলে রাতারাতি তা কমানো যাবে না। ফলে শুধু সুদহার দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সুদহার বৃদ্ধির পাশাপাশি বাজারে পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি ও উৎপাদন খরচ কমানোর পরামর্শ দেন তিনি।
শামসুল আলম আরও বলেন, দেশে পুঁজির নিরাপত্তা ও ব্যক্তির নিরাপত্তা কম। এ কারণে একদিকে পুঁজি পাচার হচ্ছে। অন্যদিকে মেধাও পাচার হচ্ছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির পাশাপাশি কার্যকর আর্থিক নীতিও লাগবে। ব্যয়বহুল প্রকল্পসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় কমাতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। তা না হলে মূল্যস্ফীতি কমবে না, মুদ্রানীতিও কার্যকর হবে না।
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যবসার খরচ কয়েক গুণ বেড়েছে বলে জানান অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, সরবরাহ খরচ, জ্বালানি ব্যয়, মজুরি, পরিষেবা খরচ ইত্যাদি সব খরচ বেড়েছে। তাহলে ব্যবসায় খরচ কমানোর জায়গা কোথায়। মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমবে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কর–হার যৌক্তিকীকরণ ও জ্বালানি ব্যয় কামনোর পরামর্শ দিয়েছেন সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ৩০ শতাংশ বেশি রাজস্ব পাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে চাইলে কর–হার যৌক্তিকীকরণ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে জ্বালানি ব্যয়ও কমানোর পরামর্শ দেন তিনি।
বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে তিনটি সমস্যাকে প্রকট হিসেবে উল্লেখ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, প্রথম সমস্যা স্বচ্ছতার; দ্বিতীয়ত, জবাবদিহির সমস্যা ও তৃতীয়ত, প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা। দেশে একেকটা সিদ্ধান্ত হচ্ছে, নীতিমালা তৈরি হচ্ছে, কে তৈরি করছেন, কীভাবে তৈরি হচ্ছে, কার স্বার্থে হচ্ছে—এসব বিষয়ে কোনো স্বচ্ছতা নেই। এগুলো যেন অনেকটা দেশের ট্রাফিক সিগন্যাল পদ্ধতির মতো। বাতি যখন সবুজ থাকে, তখন গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। আর যখন লাল থাকে, তখন গাড়ি চলে।
আনু মুহাম্মদ বলেন, বর্তমান সময়ে সে সংকট তৈরি হয়েছে, বলা হয় তার পেছনের অন্যতম কারণ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত। বলা হয়েছে, যা কিছুই করা হোক, তা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না; আদালতে যাওয়া যাবে না। এ ছাড়া যেসব চুক্তি করা হচ্ছে, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার কথা উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, বিশেষজ্ঞরা বহুবার বলেছেন, এমনকি সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকেরাও বলেছেন, এত ব্যাংকের দরকার নেই। তারপরও লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এরপর ব্যাংক খাত চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তগুলো যতটা সামনে নেওয়া হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি নেওয়া হচ্ছে পেছনে। হোটেলে বসেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দেখা যায়, কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থে সব হচ্ছে। ওই সব গোষ্ঠী কর–সুবিধা পাচ্ছে, অর্থ পাচারের সুবিধা পাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক এবং উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, তথ্য বা পরিসংখ্যানে স্বচ্ছতা না থাকলে সঠিক নীতি প্রণয়ন করা যায় না। বানানো গল্পের ওপর আলোচনা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে সেই গল্পের ভিত্তি থাকে না। অপতথ্য ও ভুল তথ্যকে আলাদা করতে হবে।
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর আরও বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির এই ভারসাম্যহীনতা হয়েছে কাঠামোগত কারণে। এটি হয়েছে বিপুল অর্থের মালিক আর নীতি প্রণেতাদের একাকার হয়ে যাওয়ার কারণে। এটা যতক্ষণ না স্বীকার করা হচ্ছে, ততক্ষণ আলোচনা এগোবে না।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, বর্তমান সরকার এক অর্থে নতুন নয়, চ্যালেঞ্জও নতুন নয়। ফলে সংকটগুলো নিয়ে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। বেনামি ঋণ ও টাকা পাচারের সুযোগ বন্ধ করতে হবে, খারাপ ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে এবং ব্যবসার পরিবেশ সহজীকরণ ও উন্নত করতে হবে।