চীনা গাড়িতে ইউরোপীয় শুল্ক, সি চিন পিং এখন কি পাল্টা ব্যবস্থা নেবেন
চীনা বিদ্যুৎচালিত গাড়ি বা ইলেকট্রিক ভেহিকেলের ওপর শুল্ক অনেকটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের জন্য এটি রীতিমতো একটি বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যখন চীনা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরও বেশি কঠোর হচ্ছে, তখন ব্রাসেলসকে ওয়াশিংটনের পথে না হাঁটতে অনুরোধ-উপরোধ জানিয়ে আসছিলেন তিনি।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বেশ কিছুদিন ধরেই চীনা ভর্তুকির বিষয়ে তদন্ত চালিয়ে আসছিল। সেই তদন্তের ফলাফল হিসেবে চীনা বিদ্যুৎচালিত গাড়িতে অতিরিক্ত শুল্ক বসানো হয়। তবে বেইজিং ইউরোপকে সতর্ক করে বলেছিল যে শাস্তিমূলক কোনো শুল্কব্যবস্থা নেওয়া হলে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাধাগ্রস্ত হবে।
বিল রুসো চীনে গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ক্রাইসলারের প্রধান ছিলেন। সাংহাইভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অটোমোবিলিটির প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। তাঁর মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের শুল্ক আরোপ করার ফলে এই মহাদেশের বিভিন্ন দেশে চীনা গাড়ির নির্মাণব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং এটা সম্ভবত প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক দিক হবে।
ইউরোপে চীনা গাড়ির বিনিয়োগ
ইলেকট্রিক গাড়ি আর ব্যাটারি তৈরির জন্য চীনা কোম্পানিগুলো অবশ্য ইতিমধ্যেই ইউরোপে বড় ধরনের বিনিয়োগের পথে এগিয়ে গেছে। বিশেষ করে চীনের বন্ধু দেশ হাঙ্গেরিতে তারা কয়েক শ কোটি ডলারের বিনিয়োগ করেছে।
তবে বিল রুসো মনে করেন, চীন থেকে ইউরোপে গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক খুব বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। বিশেষ করে বিওয়াইডির মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে। বিওয়াইডি হলো সেই চীনা কোম্পানি, যারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাতার তকমা পেতে টেসলার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। ইউরোপে বিওয়াইডির ব্যবসা রয়েছে।
বিল রুসো বলেন, ‘শুল্ক কি তাদেরকে শ্লথ করে দেবে? না। গাড়ি তৈরিতে চীনাদের যে খরচ, তার ওপর যদি আপনি এই শুল্ক যোগ করেন, তাহলে ইউরোপীয় কোম্পানির তৈরি গাড়ির চেয়েও তা প্রতিযোগিতামূলক হবে।’
সিটি গ্রুপের বিশ্লেষকেরা মনে করেন যে শুল্ক ইউরোপীয় ইউনিয়ন আরোপ করেছে, তা বিবেচনায় নিয়েও চীন থেকে বিওয়াইডি গাড়ি আমদানি করে ৭ শতাংশের মতো মুনাফা করতে পারবে। চীনের তৈরি গাড়ির উৎপাদন খরচ মূল্যায়ন করে এই হিসাব করা হয়েছে। বিওয়াইডি চীনের বাজারেও ৭ শতাংশ মুনাফা করতে পারে না।
সাংহাইভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অটোমোটিভ ফোরসাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়েল ঝ্যাং বলেন, এমনকি বিভিন্ন চীনা ব্র্যান্ডের বিদ্যুৎচালিত গাড়ি ইউরোপে যদি নিজেদের দেশের খুচরা দামের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি দামেও বিক্রি হয়, তারপরও তারা প্রতিযোগিতামূলক থাকবে।
চীনা গাড়ি রাষ্ট্রের সমর্থন কতটা পায়
সি চিন পিং মনে করেন, তাঁর দেশে তৈরি উচ্চপ্রযুক্তির পণ্য হতে যাচ্ছে বিদ্যুৎচালিত গাড়ি ও ব্যাটারি। পাশাপাশি থাকবে সোলার প্যানেল।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের হিসাবে, ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎচালিত গাড়িশিল্পে চীন রাষ্ট্রীয়ভাবে ১২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। প্রতিষ্ঠানটি অবশ্য বলেছে, তাদের হিসাব রক্ষণশীল ও চীন থেকে তারা এ বিষয়ে খুব বেশি তথ্য পায়নি বলে এটি খুব পরিষ্কার চিত্র নয়।
সি চিন পিং কী করবেন
বেইজিং অবশ্য এখনো বলেনি যে ঠিক কীভাবে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পদক্ষেপের পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। তবে দেশটি জানিয়েছে, চীনা স্বার্থ সুরক্ষা করতে তারা ‘প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ’ নেবে।
চীনা বিশেষজ্ঞ ও গাড়িশিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা ধারণা দিচ্ছেন, কর্তৃপক্ষ যেসব বিকল্প নিয়ে চিন্তা করছে, তার মধ্যে রয়েছে ইউরোপীয় ডেইরি পণ্যের বিষয়ে অনুসন্ধান চালানো থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে আমদানি করা বড় ও বিলাসবহুল গাড়িতে আরও বেশি শুল্ক বসানো।
গত জানুয়ারিতে চীন ফরাসি কনিয়াক আমদানির ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক অ্যান্টিডাম্পিং বসানো যায় কি না, তা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। চীনা বিদ্যুৎচালিত গাড়ির বিষয়ে ফ্রান্স আগ বাড়িয়ে তদন্ত করার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে প্যারিসকে শাস্তি দিতেই বেইজিং এ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করা হয়।
কিছু চীনা বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ অবশ্য সি চিন পিংকে এই বলে সতর্ক করেছেন যে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ‘ইটটি মারলে পাটকেল খেতে হবে’ ধরনের লড়াই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিকে ক্ষতি করবে। বেইজিং সম্ভবত একই সঙ্গে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ করতে চাইবে না।
শুল্কের ফলে চীনের কী ক্ষতি হবে
গোল্ডম্যান স্যাকস ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছর চীন ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার মূল্যের বিদ্যুৎচালিত গাড়ি রপ্তানি করেছে, যার এক-চতুর্থাংশ গেছে ইউরোপে। চীনের মোট রপ্তানির তুলনায় এটা এখনো বেশ কম। গত বছর চীন মোট ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল। এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র—এই দুই বাজারের প্রতিটিতে গেছে ৫০ হাজার কোটি ডলারের পণ্য।
চীনের বেশির ভাগ পণ্য অবশ্য এখন রপ্তানি হয় দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রকে তা ছাড়িয়ে গেছে। এ মাসের গোড়ার দিকে চীনের রপ্তানি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া ও লাতিন আমেরিকায় চীনের রপ্তানি আগের চেয়ে বেড়েছে। এসব বাজারে চীনের বিদুৎচালিত গাড়ির রপ্তানিও বেড়েছে।
গোল্ডম্যান স্যাকসের চীনবিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ হুই শান মনে করেন, চীন সম্ভবত উদীয়মান বাজারে রপ্তানি বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে। কারণ, বেইজিং জানে যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাণিজ্য বাধা আরও বাড়াতে পারে। গত মাসে গোল্ডম্যান স্যাকসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের মোট রপ্তানির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল বিদ্যুৎচালিত গাড়ি, সোলার সেল ও লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি। ২০১৮ সালে এই হার ছিল ১ শতাংশ।
ইউরোপ কি আরও কিছু করবে
যেসব দেশ প্রতিশোধের ভয়ে চীনা বিদ্যুৎচালিত গাড়িতে শুল্ক বাড়ানোর বিরোধিতা করেছিল, জার্মানি ছিল তার একটি। চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজ বলেছিলেন যে এ ধরনের পদক্ষেপ ‘শেষ পর্যন্ত সবকিছুর দাম বাড়িয়ে দেয়, আর সবাইকে আরও দরিদ্র বানায়’।
অনেক ইউরোপীয় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এ ধরনের পদক্ষেপ না নিতে নিজ দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। কিছু কোম্পানি আবার মনে করছে যে এই পদক্ষেপ দর–কষাকষির পথ উন্মুক্ত করবে। অন্যদিকে চীন পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য রপ্তানি কমাতে পারে কিংবা নিজেদের বাজার আরও খুলে দিতে পারে।
আগামী ২ নভেম্বর বাড়তি শুল্কসংক্রান্ত বিধান চূড়ান্ত হবে। তবে যারা এর বিরোধিতা করছে, তাদেরকে অন্তত ১৫টি দেশকে রাজি করাতে হবে এই শুল্কের বিপক্ষে অবস্থান নিতে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা আশাবাদী এই পদক্ষেপের পক্ষে তারা প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্যদেশকে পাশে পাবে। একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যদি এখনই পদক্ষেপ না নিই, আমরা কখনোই তা নিতে পারব না।’