অবণ্টিত লভ্যাংশ নিয়ে কেন টানাটানি

শেয়ারবাজারের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবণ্টিত লভ্যাংশ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি পরস্পরবিরোধী অবস্থানে।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অদাবিকৃত বা অবণ্টিত লভ্যাংশ ‘স্থিতিশীল তহবিলে’ জমা করা নিয়ে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে রশি–টানাটানি শুরু হয়েছে। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি অবণ্টিত লভ্যাংশ শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতার জন্য গঠিত তহবিলে ফেরত আনতে চায়। এ জন্য নতুন করে আইনি বিধানও করেছে সংস্থাটি। আর বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবণ্টিত লভ্যাংশ তহবিলে জমা করা যাবে না। দুই সংস্থার এমন অবস্থানের খেসারত দিতে হচ্ছে মূলত সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। কারণ, তাদের অর্থ নিয়েই দুই সংস্থার টানাটানি চলছে।

দুই খাতের দুই সংস্থার যখন এ ইস্যুতে দুই মেরুতে অবস্থান, তখন সাংবাদিকেরা এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে। ভিন্ন ভিন্ন আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি পরিচালিত হলেও দুই সংস্থারই দেখভালের দায়িত্ব অর্থমন্ত্রীর। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, দুই সংস্থা সমন্বয় করে যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটিই সরকারের সিদ্ধান্ত।

নীতিগত বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরস্পরবিরোধী এ অবস্থান নতুন কিছু নয়। অতীতে অসংখ্যবার এর নজির দেখা গেছে। গত আগস্টেও বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্দেশনা ঘিরে দুই সংস্থার সমন্বয়হীনতার বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ নিয়ে প্রতিদিন প্রতিবেদন চেয়ে চিঠি দেয়। সেই সঙ্গে শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ খতিয়ে দেখতে ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউস পরিদর্শনও শুরু করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই ব্যবস্থার পর শেয়ারবাজারে যাতে পতন না হয়, সে জন্য শেয়ারের বিপরীতে সর্বোচ্চ ঋণসীমার আওতা বাড়িয়ে সূচকের ৮ হাজার পয়েন্ট পর্যন্ত উন্নীত করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দুই সংস্থার পরস্পরবিরোধী অবস্থান তার মাধ্যমে আবারও প্রকাশ্যে আসে। এরপর সম্প্রতি দুই সংস্থার মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় সমন্বয় বৈঠক। ওই বৈঠকের কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম। এরপর ধারণা করা হয়েছিল, দুই সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার অবসান ঘটবে।

কিন্তু সর্বশেষ গত সোমবার অনুষ্ঠিত সভায় আবারও অবণ্টিত লভ্যাংশ নিয়ে দুই সংস্থার দুই অবস্থানের খবর সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী অদাবিকৃত লভ্যাংশের অর্থ শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতায় গঠিত তহবিলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে এ ধরনের অর্থ তহবিলে জমা দিয়েছে, তা–ও ফেরত আনার কথা বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলছে, এ টাকা বিনিয়োগকারীর। শেয়ারবাজারের তহবিলেই এ অর্থ স্থানান্তর করা যুক্তিযুক্ত।

প্রশ্ন জাগতে পারে, এ অবণ্টিত বা অদাবিকৃত লভ্যাংশর অর্থের মালিক আসলে কারা। এককথায় উত্তর, কিছুসংখ্যক বিনিয়োগকারী। যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে এ লভ্যাংশের দাবি করছেন না। যেমন করে ব্যাংকে বছরের পর বছর অদাবিকৃত আমানত পড়ে থাকে, ঠিক তেমনিভাবে শেয়ারবাজারের কোম্পানিগুলোতেও দীর্ঘ সময় ধরে পড়ে আছে অদাবিকৃত লভ্যাংশ। যার একটি অংশ আছে শেয়ারে, আরেকটি অংশ নগদ অর্থে। অনেক কোম্পানি এরই মধ্যে এ অর্থের অপব্যবহার করেছেন। এমন এক প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি অবণ্টিত লভ্যাংশ নিয়ে শেয়ারবাজার স্থিতিশীলতায় একটি তহবিল করার উদ্যোগ নেয়। অনেক কোম্পানি এরই মধ্যে ওই তহবিলে অবণ্টিত লভ্যাংশের অর্থ জমা দিয়েছে। এমন একপর্যায়ে এসে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অদাবিকৃত লভ্যাংশের অর্থ শেয়ারবাজারের তহবিলে জমা না করতে। মাঝপথে এসে কেন এ বাধা?

ব্যাংক কোম্পানি আইনের যে ধারার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অবণ্টিত লভ্যাংশ শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্ট তহবিলে জমার ক্ষেত্রে ‘না’ করছে, আইনের সেই ধারায় বলা আছে ভিন্ন কথা। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৩৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো আমানতের ওপর প্রদেয় ডিভিডেন্ড (লভ্যাংশ), বোনাস, লাভ বা পরিশোধযোগ্য অন্য কোনো অর্থ যে তারিখে প্রদান বা দাবিযোগ্য, সেই তারিখ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত পরিশোধ না হয় বা দাবি করা না হয়, তাহলে ওই অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা করতে হবে।

তাই শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, লভ্যাংশ কখনো আমানতের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয় না। লভ্যাংশ দেওয়া হয় মুনাফা থেকে। যার দাবিদার শেয়ারধারীরা। তাই শেয়ারধারীদের অর্থের নিরাপত্তাবিধান করা শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ। যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত, সেগুলোর বিষয়েই কেবল নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ–ও বলছেন, ব্যাংকের আমানতকারীদের অদাবিকৃত টাকা একটি নির্দিষ্ট সময় পর বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়। তেমনি শেয়ারবাজারের কোম্পানিতে পড়ে থাকা অদাবিকৃত লভ্যাংশ শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার গঠিত তহবিলে জমার বিধান করা হয়েছে।

দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরস্পরবিরোধী অবস্থান আবারও সংস্থা দুটির সমন্বয়হীনতাকে সামনে তুলে ধরেছে। বারবার দুই সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হলেও সমন্বয়হীনতা দিন দিন প্রকট হয়ে সামনে দেখা দিচ্ছে। কিন্তু দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রকাশ্য এ সমন্বয়হীনতা কারও কাম্য নয়। বরং দুই সংস্থার উচিত আমানতকারী ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা। তাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি সাধারণের আস্থা যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে মানমর্যাদা।

সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজার ইস্যুতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে যে পরস্পরবিরোধী অবস্থান, সেটিও সমাধান দরকার। সেই সমাধান শুধু মুখে মুখে নয়, দরকার কার্যক্ষেত্রে। তাহলে শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকবিদ্বেষী হবেন না, তেমনি শেয়ারবাজার মানেই ‘খারাপ’—ব্যাংকারদের এমন মানসিকতারও অবসান দরকার। সবার আগে দুই সংস্থাকেই আমানতকারী ও বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সুরক্ষা করতে হবে। একসঙ্গে মিলেও সেটি করা যায়।