আয় ও মুনাফায় শীর্ষে স্কয়ার ফার্মা

গত অর্থবছরে ওষুধ খাতের বড় ছয়টি কোম্পানির আয় আগের বছরের চেয়ে গড়ে ২১ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে মুনাফা বেড়েছে ৪৫ শতাংশ।

করোনাকালে অন্যান্য ব্যবসায় মন্দায় পড়লেও ওষুধ খাতে চাঙাভাবই দেখা গেছে। এই সময়ে ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে মুনাফাও। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত দেশের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনেও এ খাতের ভালো ব্যবসা ও মুনাফার তথ্য মিলেছে। সেখানে আয় ও মুনাফায় শীর্ষে রয়েছে স্কয়ার ফার্মা।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ওষুধ খাতের শীর্ষস্থানীয় ছয়টি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে তাদের ব্যবসা সোয়া ৯ শতাংশ থেকে ৪২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আর মুনাফা বেড়েছে প্রায় সোয়া ৮ শতাংশ থেকে ১২৬ শতাংশ পর্যন্ত। কোম্পানিগুলোর মূল ব্যবসায়ে আয় বেড়েছে। সেই সঙ্গে কারও কারও সহযোগী প্রতিষ্ঠানেরও আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময়ে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর করপোরেট করও কমেছে। কোনো কোনো কোম্পানির আয় বৃদ্ধির বিপরীতে বিপণন খরচ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে, যার প্রভাব পড়েছে মুনাফায়।

যে ছয় কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হয়, সেগুলো হলো স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, বেক্সিমকো ফার্মা, ওরিয়ন ফার্মা, রেনেটা লিমিটেড, বীকন ফার্মা ও একমি ল্যাবরেটরিজ। পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে এ ছয় কোম্পানির সম্মিলিত আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা। তাতে গড়ে এই ছয় কোম্পানির আয় বৃদ্ধি পায় ২১ শতাংশ করে। আর কোম্পানিগুলোর মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে গড়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ।

মুনাফায় সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে বীকন ফার্মার। এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির মুনাফা ৪৮ কোটি টাকা বা ১২৬ শতাংশ বেড়েছে। আলোচ্য অর্থবছরে কোম্পানিটি ৭১২ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে মুনাফা করেছে ৮৬ কোটি টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫৫৯ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে তাদের মুনাফা ছিল ৩৮ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে বীকন ফার্মার কোম্পানি সচিব খলিলুর রহমান জানান, গত অর্থবছরে তাঁদের বিপণন খরচ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। এ কারণে মুনাফায় বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তিনি আরও জানান, করোনা চিকিৎসায় তাঁরা বাজারে কয়েকটি ওষুধ এনেছেন। যেগুলো বিক্রির জন্য বাড়তি কোনো উদ্যোগ নিতে হয়নি। ফলে সেখান থেকে তুলনামূলক কম খরচে ভালো আয় হয়েছে।

একই অর্থবছরে আয়ের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ওরিয়ন ফার্মার। এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির আয় ৩১৮ কোটি টাকা বা প্রায় ৪২ শতাংশ বেড়েছে। যদিও এ আয়ের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ যোগ হয়েছে কোম্পানিটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান থেকে। ওষুধের মূল ব্যবসা থেকে কোম্পানিটির আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ। সার্বিকভাবে আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় কোম্পানিটির মুনাফাও গত অর্থবছর শেষে ৩৯ কোটি টাকা বা ৫৩ শতাংশ বেড়েছে।

ওরিয়ন ফার্মা ও বীকন ফার্মা একই শিল্পগোষ্ঠীর মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান দুটির নেতৃত্বে রয়েছেন দুই সহোদর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক (বর্তমানে লিয়েনে) মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘যাদের আয় আগে খুব কম ছিল, তারা এখন একটু ভালো করায় তাদের প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি হয়েছে। কিন্তু যারা আগে থেকেই ভালো ও বড় অঙ্কের ব্যবসা করছিল, তাদের প্রবৃদ্ধি সেই তুলনায় কম হয়েছে। কারণ, তারা সব সময়ই ভালো ব্যবসা করছে এবং স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির ধারায় রয়েছে। হঠাৎ করে তাদের আয় বা মুনাফায় সাধারণত বড় ধরনের উল্লম্ফন হয় না। আবার ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের সঙ্গে আয় তুলনা করলে স্কয়ার ও বেক্সিমকো ফার্মার মতো কোম্পানিই সব সময় ভালো অবস্থানে থাকে। সেই প্রতিফলন আমরা শেয়ারপ্রতি আয়ে দেখতে পায়।’

কোম্পানি–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনার সময়ে গত দুই বছরে অন্যান্য খাতের ব্যবসা যখন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখানে ওষুধ খাতের ব্যবসায় দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

জানতে চাইলে স্কয়ার ফার্মার নির্বাহী পরিচালক (ফিন্যান্স অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি) মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার মধ্যেও আমরা আয়ের ক্ষেত্রে দুই অঙ্কের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। অন্যান্য খাতের সঙ্গে তুলনা করলে এ সময়ে আমরা বেশ ভালো ব্যবসা করতে পেরেছি। আয়ের তুলনায় আমাদের মুনাফায় বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কারণ, করপোরেট কর কমানো হয়েছিল গত অর্থবছরে।’

স্কয়ার ফার্মার গত পাঁচ বছরের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরের মধ্যে কোম্পানিটির আয় প্রথমবারের মতো সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। গত অর্থবছরে কোম্পানিটি ৫ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা আয় করেছে। এ আয় থেকে সব ধরনের খরচ ও সরকারের কর বাদ দেওয়ার পর কোম্পানিটির মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা। আগের বছর মুনাফার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা।

ওষুধ খাতের অপর কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মার আয় বেড়েছে ৩৮৮ কোটি টাকা। আর একই সময়ে কোম্পানিটির মুনাফা বেড়েছে ১৬৩ কোটি টাকা বা ৪৬ শতাংশ। সর্বশেষ অর্থবছরে বেক্সিমকো ফার্মার কর–পরবর্তী মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১৭ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩৫৪ কোটি টাকা।

এ ছাড়া অর্থবছরে রেনেটা ২ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে মুনাফা করেছে ৫০৩ কোটি টাকা। কোম্পানিটির আয় ও মুনাফায় ২১ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে করোনার এ সময়ে। আর একমি ল্যাবরেটরিজের আয় আগের বছরের চেয়ে ৯ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ওই আয়ের বিপরীতে কোম্পানিটি মুনাফা করেছে ১৫৭ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে সোয়া ৮ শতাংশ বেশি।

এদিকে মুনাফায় বড় প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি পুঁজিবাজারে শেয়ারের দামেও বড় উত্থান হয়েছে বীকন ফার্মার। গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ১৮৭ টাকা বা ২৬১ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে ওরিয়ন ফার্মার শেয়ারের দাম বেড়েছে ৫৮ টাকা বা ১২৮ শতাংশ। একমির শেয়ারের দাম ১৪ টাকা বা ১৯ শতাংশ ও রেনেটার শেয়ারের দাম ১৬৯ টাকা বা ১৫ শতাংশ বেড়েছে। অবশ্য একই সময়ে স্কয়ার ফার্মা ও বেক্সিমকোর শেয়ারের দাম কমেছে। স্কয়ার ফার্মার শেয়ারের দাম এক বছরে ২০ টাকা বা ৮ শতাংশ এবং বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ারের দর ৩ টাকা বা দেড় শতাংশ কমেছে।