ঢাকার বাজারে লেনদেন ২০১০ সালের অবস্থানে

ডিএসইতে গতকাল দিন শেষে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা, যা আগের দিনের চেয়ে ২৬৭ কোটি টাকা বেশি।

নতুন বছরে দেশের শেয়ারবাজারে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়েছে। বছরের প্রথম কার্যদিবসে সূচকের বড় উত্থানের পর গতকাল সোমবার লেনদেন ছাড়িয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা। তাতে লেনদেন ফিরে গেছে ২০১০ সালের বাজারধসের আগের অবস্থানে। লেনদেনের পাশাপাশি সূচকও রয়েছে ঊর্ধ্বমুখী ধারায়।

নতুন বছরটি শুরু হয়েছিল সূচক ও লেনদেনের বড় উত্থান দিয়ে। বছরের প্রথম কার্যদিবসে গতকাল সোমবার দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছিল ২১৭ পয়েন্ট বা ৪ শতাংশ। আর ওই দিন লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই করছিল। আগের দিনের বড় উত্থানের পর গতকাল লেনদেন শুরু হয় সূচকের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এদিন ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৩৩ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৬৫২ পয়েন্টে। সূচকে কিছুটা ধীরগতি থাকলেও লেনদেনের ক্ষেত্রে ছিল বেশ গতি। তাতে গতকাল দিন শেষে লেনদেন ছাড়িয়েছে ২ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, স্বাভাবিক দিনের লেনদেন বিবেচনায় নিলে প্রায় ১০ বছর পর গতকালই ঢাকার বাজারে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে। এর আগে সর্বশেষ ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর ২ হাজার ৭১১ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। এরপর গত বছরের ২৮ জুন অবশ্য ২ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। এ লেনদেনের সিংহভাগই ছিল শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনের মালিকানা বদলের। গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনকে কিনে নিয়েছে আরেক বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার। শেয়ারবাজারের মাধ্যমে এ মালিকানার শেয়ারের হাতবদল হয়েছিল। সে জন্য ওই দিন লেনদেন হঠাৎ করে আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তাই ওই দিনের লেনদেনের পরিমাণকে স্বাভাবিক দিনের লেনদেনের সঙ্গে তুলনায় নেওয়া হয় না।

দেশের অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচকটি গতকাল ১০৭ পয়েন্ট বেড়েছে। আর সেখানকার বাজারে দিন শেষে লেনদেনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৮২ কোটি টাকা, যা আগের দিনের চেয়ে প্রায় ১৪ কোটি টাকা বেশি।

ঢাকার বাজারে গতকাল লেনদেনের পুরোটা সময় ধরেই সূচকের বেশ উত্থান-পতন দেখা যায়। আর সূচকের এ উত্থান-পতনে বড় ভূমিকা ছিল বেক্সিমকো গ্রুপের দুটি কোম্পানির। ভারতে অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা তৈরি ও বাংলাদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে। ভারতে এ টিকা তৈরি ও বাজারজাত করবে সেরাম ইনস্টিটিউট। সেখান থেকে বাংলাদেশে এ টিকা আনবে সরকারের কাছে বিক্রি করবে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। এ জন্য বেক্সিমকো বাংলাদেশ সরকার ও সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে আলাদা আলাদা চুক্তি করেছে।

বাংলাদেশের জন্য বেক্সিমকো ফার্মা টিকা আমদানি করবে, এ খবরেই মূলত বেশ কিছুদিন ধরে শেয়ারবাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়ছিল। কিন্তু ভারত করোনার টিকা রপ্তানি করতে পারবে কি পারবে না, এ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। এ দোলাচলে গতকাল লেনদেন শুরুর পর থেকে বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ারের দামও ওঠানামা করে। দিন শেষে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম আগের দিনের চেয়ে ৩ শতাংশ বা ৬ টাকা কমে নেমে এসেছে ২০৩ টাকায়। বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ারের দাম কমলেও বেক্সিমকো লিমিটেডের দাম বেড়েছে। এদিন বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারের দাম প্রায় ৩ টাকা বা পৌনে ৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬ টাকায়।

দামের হেরফের হলেও বেক্সিমকো লিমিটেড ও বেক্সিমকো ফার্মা ছিল লেনদেনের প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে। ঢাকার বাজারে গতকাল দুই কোম্পানির সম্মিলিত লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৪৫৯ কোটি টাকা। ঢাকার বাজারের মোট লেনদেনের ২১ শতাংশই ছিল এ দুই কোম্পানির দখলে।

বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শেয়ারবাজারে নতুন করে অর্থ ঢুকছে। কিছু কিছু ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে ৫ থেকে ২০ কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগ বাজারে আসছে। সেই সঙ্গে রয়েছে পুরোনো বিনিয়োগ। ব্যবসায়ী ও শিল্পমালিকদের কাছ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য বেশি অর্থ আসছে বলে একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ ব্যক্তিরা প্রথম আলোকে জানান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইতে শীর্ষ লেনদেনকারী একটি ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিনই ব্যবসায়ীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য আমাদের অর্থ দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, এ বিনিয়োগের বিপরীতে ১০ শতাংশের বেশি মুনাফা পেলেই তাঁরা খুশি। কারণ, ব্যাংকে টাকা রেখে এখন ৫ শতাংশের বেশি মুনাফা পাওয়া যায় না। এ কারণে ব্যাংকের বিকল্প হিসেবে ব্যবসায়ী ও শিল্পমালিকদের একটি অংশ শেয়ারবাজারকে বেছে নিয়েছেন।’

গত বছরের এপ্রিল থেকে ব্যাংকে সুদের হার একক অঙ্কে নামিয়ে আনা হয়। এতে আমানতের বিপরীতে গড় সুদহার নেমে আসে ৫ শতাংশের নিচে। এ ছাড়া করোনার কারণে ব্যবসা যেমন খারাপ, তেমনি শিল্পে বিনিয়োগেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ফলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ছে। একই অবস্থা বিশ্ব শেয়ারবাজারেও। করোনায় যেখানে বিশ্ব অর্থনীতি স্থবির, সেখানে বিশ্বের দেশে দেশে শেয়ারবাজারে নতুন নতুন রেকর্ড হয়।

জানতে চাইলে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নেওয়া বেশ কিছু পদক্ষেপ ও রবির তালিকাভুক্তির কারণে বাজারে নতুন করে গতি সঞ্চার হয়েছে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও আবেদনের ক্ষেত্রে সেকেন্ডারি বাজারে ন্যূনতম বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা ও ব্রোকারেজ হাউসের শাখা খোলার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া, দেশ-বিদেশে ডিজিটাল বুথ খোলার অনুমোদন। নতুন এ গতির কারণে বাজারে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ অর্থ লগ্নি হচ্ছে।