দামের চাপ সামলাতে কাঁচাবাজারেই লাগাম

■ ভারতে পেঁয়াজের দাম ৩৩% বেড়েছে। বাড়তি দেশেও।

■ বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, টনপ্রতি ১০০ ডলার করে বেড়েছে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম।

■ বিশ্ববাজারে চিনির দাম বেড়েছে।

ফাইল ছবি

করোনাকালে আয় কমেছে। সঙ্গে ভবিষ্যৎও সুনিশ্চিত নয়। তাই হাত খুলে বাজার করার সুযোগ আর নেই। এর মধ্যে সবজির বাজারের যা অবস্থা, তাতে পকেটে টান পড়ার জোগাড়।

কাঁচাবাজারে এখন মোটামুটি ২০ পদের সবজি বিক্রি হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩টির কেজিপ্রতি দর ৫০ টাকার নিচে। এগুলো হলো কাঁচা পেঁপে, মিষ্টিকুমড়া ও আলু। বাকিগুলো কিনতে লাগবে কেজিপ্রতি ১২০ টাকা পর্যন্ত। ওই তিনটি সবজি যে সস্তা, তা–ও বলা যাবে না।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটের সবজি বিক্রেতা জাকির হোসেন গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি মিষ্টিকুমড়া ৩৫ টাকা দরে বিক্রি করছিলেন, যা সাধারণত ২৫ টাকার আশপাশে থাকে। কাঁচা পেঁপের কেজি ৪০ টাকা, যেটা মানুষ ২০ থেকে ৩০ টাকা কেজির মধ্যে কিনতে অভ্যস্ত।

আর আলু প্রতি কেজি ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা গেল। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এই দর গত বছরের এই সময়ের তুলনায় প্রায় ৪৯ শতাংশ বেশি।

জাকির হোসেন বললেন, দাম বেশি বলে ক্রেতাও কম। তাঁর পরিচিত ক্রেতাদের অনেকেই এখন কম পরিমাণে সবজি কেনেন। কেউ কেউ পরিবারসহ গ্রামেও চলে গেছেন।

মানুষ কম কিনলেও মূল্যস্ফীতি কিন্তু বাড়ছে। সাধারণত চাহিদা কমলে পণ্যের দাম পড়তির দিকে থাকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ শতাংশের বেশি।

যা–ই হোক, এখনকার সবজি বাজারকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। ‘ভিআইপি’ শ্রেণিতে রয়েছে বেগুন, করলা ও টমেটো। দাম প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১২০ টাকা। এর পরে ৬০ টাকা বা তার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বেশির ভাগ সবজি। পটোল, কচুমুখি, লতি, হাইব্রিড শসা ইত্যাদি ৫০ টাকা প্রতি কেজি। কাঁচামরিচের দাম খুব চড়া। আড়াই শ গ্রাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা।

শুধু সবজি নয়, বাজারে এখন চাল, ডাল, ডিম, গরুর মাংস ও আদার দাম চড়া। গত দুই সপ্তাহে নতুন করে বেড়েছে ভোজ্যতেল ও পেঁয়াজের দাম। এত দিন সস্তায় বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০ টাকা বাড়তি। ফলে মানুষের স্বস্তি নেই।

দু-একটি দোকানে শীতের সবজি ফুলকপি, বাঁধাকপি ও শিম দেখা গেল। দাম খুব চড়া। প্রতিটি ছোট ফুলকপি ও বাঁধাকপি ৫০-৬০ টাকা ও শিমের কেজি ১৮০ টাকা চাইছিলেন বিক্রেতারা। আর ক্রেতারা দাম শুনে অন্য দিকে হাঁটা দিচ্ছিলেন।

সবজির চড়া দাম মাসখানেকের বেশি সময় ধরে। কারণ বন্যা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সবজির খেত পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সরবরাহ মাস দু-এক ধরেই কম। তাই দাম নাগালে আসছে না। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর কৃষকেরা নতুন সবজির চারা আবাদ করবেন। দাম কমতে আরও দুই মাস লাগতে পারে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, বর্ষা মৌসুমে সবজি উৎপাদন শীতের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ৪৫ লাখ টন সবজি উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে শীতে হয়েছে প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। বিপরীতে বর্ষায় উৎপাদিত হয়েছে ২০ লাখ টনের কিছু কম। বিবিএস ৪২ ধরনের শাকসবজির উৎপাদনের হিসাব রাখে।

শুধু সবজি নয়, বাজারে এখন চাল, ডাল, ডিম, গরুর মাংস ও আদার দাম চড়া। গত দুই সপ্তাহে নতুন করে বেড়েছে ভোজ্যতেল ও পেঁয়াজের দাম। এত দিন সস্তায় বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০ টাকা বাড়তি। ফলে মানুষের স্বস্তি নেই।

মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটে কেনাকাটা করতে গিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা মহিউদ্দিন আহমেদ। বাজার নিয়ে আলাপকালে অবসরপ্রাপ্ত ওই সরকারি কর্মচারী বললেন, তাঁর পরিবার চলে বাসা ভাড়ার টাকা দিয়ে। করোনার মধ্যে একটি পরিবার গ্রামে চলে গেছে। বাসাটি ভাড়া হয়নি। দুটিতে ভাড়া কমিয়েছেন দুই হাজার টাকা করে।

মহিউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, অন্যান্য খরচ কমানোর সুযোগ নেই। তাই বাজার খরচই কমাতে হয়েছে। আগে যে সবজি তিনি এক কেজির কমে কিনতেন না, সেটা কেনেন আধা কেজি করে। আর বেশি দামিগুলো কেনেনই না।

সকালে বাজারদর দেখা শুরু করেছিলাম মিরপুরের দক্ষিণ মনিপুরের মফিজুর রহমানের দোকান থেকে। তিনি জানালেন, ফার্মের বাদামি ডিমের হালিপ্রতি দাম ৩৮ টাকা। একটি নিলে ১০ টাকা। জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোর সরু মিনিকেট চালের কেজিপ্রতি দর ৬০ টাকা। আর মাঝারি বিআর আটাশ চাল ৫০ টাকা কেজি বিক্রি করছেন বিক্রেতারা।

সেখানে থেকে মিরপুর-১ নম্বর সেকশন, মাজার রোড, কল্যাণপুর হয়ে টাউন হল মার্কেট ঘুরে কারওয়ান বাজারে গিয়ে চড়া দামের চিত্রই দেখা গেল। যেমন ভারতীয় পেঁয়াজের কেজি দুই সপ্তাহ আগেও ২৫ থেকে ৩০ টাকা ছিল। এখন সেটা ৪০ টাকায় উঠেছে। আর দেশি পেঁয়াজ জাতভেদে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। চীনা রসুন দুই রকম। ভালোটির কেজি ১২০ টাকা, সাধারণটি ৮০ থেকে ৯০ টাকা। অবশ্য এক কেজি চীনা আদা কিনতে মোটামুটি দুই কেজি রসুনের সমান দাম দিতে হবে। খুচরা বাজারে চীনা আদা প্রতি কেজি ২২০ টাকা এবং মিয়ানমার ও ভারতের আদা ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

ভারতের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার মহারাষ্ট্রের লাসালগাঁওয়ে পেঁয়াজের পাইকারি দর ৩৩ শতাংশ বেড়েছে
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন

বিশ্ববাজারেও দাম বাড়তি

কারওয়ান বাজারের মসলাজাতীয় পণ্য বিক্রেতা আবুল হোসেন বলেন, ভারতে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশেও বাড়তি।

ভারতীয় পত্রিকা টাইমস অব ইন্ডিয়ার অনলাইনে ৩০ আগস্টের এক প্রতিবেদন বলছে, ভারতের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার মহারাষ্ট্রের লাসালগাঁওয়ে পেঁয়াজের পাইকারি দর ৩৩ শতাংশ বেড়েছে।

বিশ্বব্যাংক গত বুধবার বৈশ্বিক পণ্য বাজার পরিস্থিতির একটি হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, তিন মাসে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম টনপ্রতি প্রায় ১০০ ডলার করে বেড়েছে। বাড়তি চিনির দামও। মানুষের জন্য তেমন কোনো সুখবরও নেই।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, করোনার মধ্যে বন্যা এল। এখন জিনিসপত্রের দাম চড়া। এটা মানুষের জন্য যুগল ধাক্কা। তিনি আরও বলেন, মানুষের কষ্টের মাত্রা বাড়ছে। এ সময় গা–ছাড়া ভাব দেখানোর সুযোগ নেই। মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।