নতুন সিদ্ধান্তে নানা প্রশ্ন বাজারে

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত তিন কোম্পানির উদ্যোক্তা–পরিচালকদের নতুন করে শেয়ার বিক্রির নির্দেশনা নিয়ে বাজারে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্টদের একটি বড় অংশই এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছে। আর নির্দেশনার খবরে গতকাল তিন কোম্পানিরই শেয়ারের সর্বোচ্চ দরপতন ঘটেছে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত রোববার তালিকাভুক্ত তিন কোম্পানির জন্য নতুন এক নির্দেশনা জারি করে। কোম্পানি তিনটি হচ্ছে বহুজাতিক বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড, ওয়ালটন হাই–টেক ইন্ডাস্ট্রিজ ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। বিএসইসির নির্দেশনায় এই তিন কোম্পানিকে বাজারে লেনদেনযোগ্য শেয়ার বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিএসইসির নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কোম্পানিগুলোকে আগামী এক বছরের মধ্যে বাজারে লেনদেনযোগ্য শেয়ারের পরিমাণ পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। প্রতি মাসে একেকটি কোম্পানি সর্বোচ্চ ১ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার ছাড়তে পারবে। আর উদ্যোক্তা–পরিচালকদের অংশ থেকেই এ শেয়ার ছাড়তে হবে।

বিএসইসির এ নির্দেশনা নিয়ে বাজারে সমালোচনার জায়গাটি উদ্যোক্তা–পরিচালকদের অংশ থেকে শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়ে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এতে কোম্পানি কোনোভাবেই লাভবান হবে না। লাভবান হবেন উদ্যোক্তা–পরিচালকেরা। কারণ, শেয়ার বিক্রির টাকা তাঁদের পকেটে যাবে। এতে বিনিয়োগকারীদের টাকায় কিছুসংখ্যক মানুষের পকেট ভারী হবে। বাজার–সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে বাজার থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বেরিয়ে যাবে।

জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নতুন এ সিদ্ধান্তের ফলে বিনিয়োগকারীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ সরাসরি কিছুসংখ্যক উদ্যোক্তা–পরিচালকের পকেটে চলে যাবে। কোম্পানির তাতে কোনো লাভ হবে না। আর কোম্পানির লাভ না হলে তাতে বিনিয়োগকারীদেরও উপকৃত হওয়ার কোনো আশা থাকে না। তাই যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে সেটি হবে অন্যায়।

শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরাসরি তালিকাভুক্তি বা ডিরেক্ট লিস্টিং পদ্ধতিতেই মূলত উদ্যোক্তা–পরিচালকেরা সরাসরি শেয়ার বিক্রির সুযোগ পান। উদ্যোক্তা–পরিচালকদের শেয়ার বিক্রির সেই টাকা কোম্পানির বদলে যিনি বা যাঁরা বিক্রি করছেন, তাঁদের পকেটে যায়। বর্তমানে শেয়ারবাজারে সরকারি কোম্পানি বাদে বেসরকারি কোনো কোম্পানির জন্য সরাসরি তালিকাভুক্তির বিধান নেই। বাজার–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিন কোম্পানির উদ্যোক্তা–পরিচালকদের নতুন করে শেয়ার বিক্রির যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেটি অনেকটা সরাসরি তালিকাভুক্তির পদ্ধতির মতোই। কেন বেসরকারি কোম্পানিকে এ ধরনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, সেই প্রশ্নই তুলেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

তার প্রমাণ মেলে গতকাল কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দামে। নতুন করে শেয়ার বিক্রির নির্দেশনার খবরে গতকাল শেয়ারবাজারে তিন কোম্পানিরই সর্বোচ্চ দরপতন ঘটেছে। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গতকাল সোমবার দরপতনের শীর্ষে ছিল যথাক্রমে আইসিবি, ওয়ালটন ও বার্জার পেইন্টস।

জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, বিএসইসি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি মূলত উদ্যোক্তা–পরিচালকদের শেয়ার বিক্রিতে বাধ্য করা। এতে বিনিয়োগকারী ও কোম্পানি কেউ লাভবান হবে না। বরং রিপিট আইপিওর মাধ্যমে নতুন শেয়ার ইস্যু বা অন্য কোনো পন্থায় বাজারে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের পরিমাণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল। তাতে কোম্পানিগুলোর ব্যবসা সম্প্রসারণ বা বড় করার সুযোগ তৈরি হতো।

এদিকে গতকাল সকাল থেকেই শেয়ারবাজারে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল তিন কোম্পানির নতুন শেয়ার ছাড়ার সিদ্ধান্তের বিষয়টি। শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরুর পর থেকে বিনিয়োগকারীদের চোখ ছিল এ তিন শেয়ারের প্রতি। গতকাল মতিঝিলের একাধিক ব্রোকারেজ হাউস ঘুরে দেখা যায়, বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তা—সবার মুখে মুখেই ছিল তিন কোম্পানির নতুন করে শেয়ার ছাড়ার বিষয়ে আলোচনা। এ সিদ্ধান্তের ফলে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম কতটা কমবে নাকি বাড়বে, তা নিয়েও নানা পাল্টাপাল্টি যুক্তি উঠে আসে আলোচনায়। পাল্টাপাল্টি যুক্তির ফাঁকে ফাঁকে ব্রোকারেজ হাউসের বড় মনিটরে কিছুক্ষণ পরপর কোম্পানিগুলোর কত শেয়ারের হাতবদল হলো, তারও খোঁজখবর নিতে দেখা যায়।

ডিএসইতে গতকাল তিন কোম্পানির মধ্যে ওয়ালটনের শেয়ারে সকাল থেকে ছিল ক্রেতাসংকট। সাধারণত ডিএসইর লেনদেনযন্ত্রে ১০টি করে ক্রয়াদেশ ও বিক্রয়াদেশ দৃশ্যমান থাকে। সেখানে ক্রেতা–বিক্রেতা কম দামে কত শেয়ার কেনাবেচা করতে চান তা দেখা যায়। কিন্তু লেনদেনযন্ত্রে এদিন ওয়ালটনের কোনো ক্রয়াদেশ দৃশ্যমান ছিল না। তবে দিনের সর্বনিম্ন দামে ৪৩ হাজার শেয়ারের হাতবদল হয়। এদিন কোম্পানিটির শেয়ারের দাম সোয়া ৬ শতাংশ বা প্রায় ৯০ টাকা কমে দিনের সর্বনিম্ন দাম ১ হাজার ৩৪৮ টাকায় লেনদেন হয়।

অপর দুই কোম্পানির মধ্যে বার্জারের দাম ১১৮ টাকা বা প্রায় সোয়া ৬ শতাংশ কমে নেমে এসেছে ১ হাজার ৮০৩ টাকায়। আর আইসিবির দাম প্রায় পৌনে ৯ শতাংশ বা ১২ টাকা কমে নেমে এসেছে ১৩০ টাকা।

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ওয়ালটনের লেনদেনযোগ্য শেয়ার রয়েছে মাত্র ১ শতাংশ। বাকি ৯৯ শতাংশ শেয়ার কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে রয়েছে। বিএসইসির নতুন নির্দেশনার ফলে ওয়ালটনের উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে থাকা শেয়ার থেকে ৯ শতাংশ শেয়ার নতুন করে বাজারে ছাড়তে হবে। একইভাবে বহুজাতিক কোম্পানি বার্জার পেইন্টসকে নতুন করে আরও ৫ শতাংশ এবং আইসিবিকে প্রায় ৭ শতাংশ শেয়ার বাজারে ছাড়তে হবে।

জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ভালো শেয়ারের প্রতি দেশি–বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ রয়েছে। সে জন্য উল্লেখিত তিন কোম্পানির লেনদেনযোগ্য শেয়ার বাড়াতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।