মসলার গুঁড়া তৈরির নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন

দেশে ১৮ ধরনের মসলার গুঁড়া, স্লাইস কিংবা পেস্ট, সস–আচার ইত্যাদি তৈরি ও মোড়কজাত করার নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে।

মসলাগুলো হচ্ছে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, রসুন, আদা ও অলস্পাইসের (চায়নিজ মসলা) গুঁড়া, কাঁচা মরিচের পেস্ট ও আচার, শুকনা মরিচের আচার ও সস, কাঁচা মরিচ খাদ্যজাতকরণ (অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায়), রসুনের আচার, কেচাপ ও চাটনি, আদার আচার ও জ্যাম, হলুদের পেস্ট, অলস্পাইসের পেস্ট এবং অ্যানাটো পাউডার।

প্রতীকী ছবি

বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মাসুদ আলম ১৮ ধরনের মসলার গুঁড়া, স্লাইস কিংবা পেস্ট বা সস–আচার ইত্যাদি তৈরি ও মোড়কজাত করার নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। মসলাগুলো হচ্ছে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, রসুন, আদা ও অলস্পাইসের (চায়নিজ মসলা) গুঁড়া, কাঁচা মরিচের পেস্ট ও আচার, শুকনা মরিচের আচার ও সস, কাঁচা মরিচ খাদ্যজাতকরণ (অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায়), রসুনের আচার, কেচাপ ও চাটনি, আদার আচার ও জ্যাম, হলুদের পেস্ট, অলস্পাইসের পেস্ট এবং অ্যানাটো পাউডার।

প্রাণ গ্রুপসহ নামীদামি কিছু কোম্পানি ইতিমধ্যে মো. মাসুদ আলমের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহার করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের মসলার গুঁড়া, পেস্ট, সস, আচার ইত্যাদি বিপণনে আগ্রহ দেখিয়েছে। ভোক্তা পর্যায়েও এসব পণ্য তৈরি ও সংরক্ষণ করে ব্যবহার করা যাবে বলে জানান মাসুদ আলম।

জানতে চাইলে বিজ্ঞানী মাসুদ আলম সম্প্রতি প্রথম আলোকে জানান, তাঁর উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও পদ্ধতিতে পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন মসলার গুঁড়া, পেস্ট, আচার, সস ইত্যাদি প্যাকেটজাত করে ব্যবহার শুরু হয়েছে। তবে তা ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভোক্তা পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হলে তাতে দেশে মসলার অপচয় ও আমদানিনির্ভরতা কমবে।

যেভাবে উদ্ভাবন

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) নিয়ন্ত্রণাধীন বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার রায়নগরের মসলা গবেষণা কেন্দ্রে ২০০৪ সাল থেকে বিজ্ঞানী মো. মাসুদ আলম মসলা প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একবার আমেরিকা থেকে আমার এক আত্মীয় কয়েক প্যাকেট পেঁয়াজ ও রসুনের গুঁড়া পাঠিয়েছিলেন। সেটা দেখেই পেঁয়াজগুঁড়া নিয়ে গবেষণার ধারণা মাথায় আসে। কাজ শুরু করি, সফলও হই। এরপর রসুন, আদা, কাঁচা মরিচসহ পর্যায়ক্রমে অন্যান্য মসলা নিয়েও কাজ করি। তাতেও সাফল্য ধরা দেয়। তখন অন্য বিজ্ঞানীদের দিয়েও দফায় দফায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও পদ্ধতিতে তৈরি গুঁড়া ও পেস্ট করা মসলার গুণগত মান, স্বাদ ও ঝাঁজ ঠিক আছে কি না, তা নিশ্চিত হয়েছি। পরে মসলার গুঁড়া, পেস্ট, আচার ইত্যাদি মোড়কজাত করে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার শুরু হয়েছে।

অপচয় ঠেকাবে নতুন পদ্ধতি

মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা বলছেন, পেঁয়াজ একটি পচনশীল পণ্য। দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের প্রায় ৩০ শতাংশ অপচয় হয়। আমদানি করা পেঁয়াজে অপচয়ের হার ৫ থেকে ৭ শতাংশ। মাঠ থেকে পেঁয়াজ তোলার পর তা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে গুঁড়া কিংবা স্লাইস করে সংরক্ষণ করা সম্ভব হলে অপচয় রোধ করা সম্ভব। কারণ, প্রক্রিয়াজাত পেঁয়াজ দুই–তিন বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। এতে পণ্যটির ঘাটতি ঠেকানো ও আমদানিনির্ভরতা কমানো সম্ভব। একইভাবে রসুন, কাঁচা মরিচ, আদাসহ অন্য মসলার অপচয়ও রোধ করা সম্ভব।

মসলাজাতীয় ফসলের গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্পের পরিচালক শৈলেন্দ্র নাথ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, পেঁয়াজগুঁড়া ও স্লাইস আকারে বাজারজাত করা সম্ভব হলে পণ্যটির আমদানিনির্ভরতা অনেকখানি কমে আসবে। তিনি জানান, দেশে ৫৩ রকমের মসলা ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় ৩৫টি মসলা।

কৃষক ও উদ্যোক্তারা সহজেই পেঁয়াজ গুঁড়া করে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে পারবেন। খোসা ছাড়ানোর পর পেঁয়াজকে স্লাইস করে ফুটন্ত পানির বাষ্পে ভাপ দিতে হবে। আধা সেদ্ধ হওয়ার পর প্রিজারভেটিভ, সোডিয়াম মেটাবাই সালফাইড মেশানো পানিতে আধা সেদ্ধ পেঁয়াজ কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখতে হবে।
বিজ্ঞানী মাসুদ আলম

গুঁড়া মসলা প্রযুক্তি

বিজ্ঞানী মাসুদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, কৃষক ও উদ্যোক্তারা সহজেই পেঁয়াজ গুঁড়া করে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে পারবেন। খোসা ছাড়ানোর পর পেঁয়াজকে স্লাইস করে ফুটন্ত পানির বাষ্পে ভাপ দিতে হবে। আধা সেদ্ধ হওয়ার পর প্রিজারভেটিভ, সোডিয়াম মেটাবাই সালফাইড মেশানো পানিতে আধা সেদ্ধ পেঁয়াজ কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখতে হবে। এরপর স্লাইস রোদে বা তাপে শুকানোর পর তা গুঁড়া করে সংরক্ষণ কিংবা রান্নায় ব্যবহার করা যাবে। এক কেজি পেঁয়াজ শুকিয়ে সর্বোচ্চ ২০০ গ্রাম পেঁয়াজগুঁড়া মিলবে। এরপর তা পলিব্যাগে মোড়কজাত করে সংরক্ষণ ও বিপণন করা সম্ভব। পেঁয়াজের মতো প্রক্রিয়াজাত করে আদা ও রসুনও গুঁড়া করে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করা সম্ভব।

মাসুদ আলম বলেন, বাঙালি রমণীরা রান্নায় পেঁয়াজকুচি ও পেঁয়াজবাটা করে রান্নায় অভ্যস্ত। পেঁয়াজকুচি বা বাটা নানা ভোগান্তির কাজ। অথচ হাতের কাছে পেঁয়াজগুঁড়া থাকলে ঝটপট রান্না করা সম্ভব। কোনো বাসায় পাঁচ কেজি পেঁয়াজ লাগলে সেখানে এক কেজি পেঁয়াজগুঁড়াই যথেষ্ট।

উদ্ভাবক মাসুদ আলম বলেন, দেশে রেকর্ড পরিমাণ কাঁচা মরিচ উৎপাদিত হয়। সংরক্ষণের সুবিধা না থাকায় উৎপাদন মৌসুমে কৃষক ৫ থেকে ১০ টাকা কেজি দরে কাঁচা মরিচ বিক্রি করেন। কাঁচা মরিচ স্লাইস করে শুকিয়ে কিংবা তা গুঁড়া করে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করা যায়। এতে কাঁচা মরিচের স্বাদ ও গুণগত মান অক্ষুণ্ন থাকবে।

পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচ গুঁড়া করে বাজারজাতকরণ আমাদের কাছে অভিনব মনে হয়েছে। বিজ্ঞানী মাসুদ আলমের সঙ্গে কথা বলে এ পণ্য সম্পর্কে ধারণা নিয়েছি।
ড্রিমস বায়োটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আবদুল হক সিদ্দিকী

জানতে চাইলে দেশে গুঁড়া মসলা বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ গ্রুপের সহকারী ব্যবস্থাপক মবিনুল জাকির প্রথম আলোকে বলেন, ‘মসলা গবেষণা কেন্দ্র উদ্ভাবিত পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, রসুন ও আদাগুঁড়া বাজারজাতকরণ নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি। ইতিমধ্যে আমরা সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীর সঙ্গে দেখা করে এ সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করেছি। এখন এই পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ, বাণিজ্যিক চাহিদা—এসব বিষয়ে যাচাই–বাছাই করছি।’

আরেক প্রতিষ্ঠান ড্রিমস বায়োটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আবদুল হক সিদ্দিকী বলেন, ‘পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচ গুঁড়া করে বাজারজাতকরণ আমাদের কাছে অভিনব মনে হয়েছে। বিজ্ঞানী মাসুদ আলমের সঙ্গে কথা বলে এ পণ্য সম্পর্কে ধারণা নিয়েছি।’

মসলা গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হামীম রেজা সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, সংরক্ষণের অভাবে যে ৩০ শতাংশ মসলা অপচয় হচ্ছে, তা রোধ করতে পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা মরিচ, আদার মতো মসলা গুঁড়া করার প্রযুক্তি ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এখন নামীদামি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন মসলার গুঁড়া, পেস্ট, স্লাইস ইত্যাদি বাজারজাত করা সম্ভব হলে মসলার অপচয় ও আমদানিনির্ভরতা কমবে। কৃষকের ন্যায্য দাম পাওয়াও নিশ্চিত হবে।