লভ্যাংশের শীর্ষে ইউনাইটেড,স্কয়ার ও ওয়ালটন

দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে গত জুনে সমাপ্ত ২০২০-২১ আর্থিক বছরে লভ্যাংশ প্রদানে শীর্ষে ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলো। এই আর্থিক বছরের জন্য লভ্যাংশ প্রদানকারী শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে পাঁচটিই ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের। কোম্পানিগুলো হচ্ছে ইউনাইটেড পাওয়ার, সামিট পাওয়ার, তিতাস গ্যাস, মবিল যমুনা লুব্রিকেন্টস ও মেঘনা পেট্রোলিয়াম। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

লভ্যাংশ প্রদানে শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেরই পাঁচটি—ইউনাইটেড পাওয়ার, সামিট পাওয়ার, তিতাস গ্যাস, মবিল যমুনা লুব্রিকেন্টস ও মেঘনা পেট্রোলিয়াম।

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, এই বাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অর্থবছরের (জুলাই-জুন) সঙ্গে মিল রেখে কোম্পানির আর্থিক বছরের হিসাব করা হয়, এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৫৬। আর ক্যালেন্ডার তথা পঞ্জিকা বছরের (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) সঙ্গে মিল রেখে আর্থিক বছরের হিসাব গণনাকারী কোম্পানির সংখ্যা ১২০। এর বাইরে এক বছরের এপ্রিল থেকে অন্য বছরের মার্চ সময়কাল ধরে আর্থিক বছর হিসাব করে চারটি প্রতিষ্ঠান। আর দুটি প্রতিষ্ঠান আর্থিক বছরের হিসাব করে অক্টোবর-সেপ্টেম্বর সময়ের ভিত্তিতে।

এই প্রতিবেদন তৈরিতে শুধু জুলাই-জুন আর্থিক বছরের ভিত্তিতে যেসব প্রতিষ্ঠান নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, সেগুলোকেই বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এসব কোম্পানির নগদ লভ্যাংশের বাইরে বোনাস বা স্টক লভ্যাংশের হিসাবটিও এখানে ধরা হয়নি। এ ছাড়া ডিসেম্বর ও মার্চে আর্থিক বছর গণনাকারী বহুজাতিক কোম্পানিসহ ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের হিসাবটি এ প্রতিবেদনে বিবেচনায় আসেনি। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত দেশের শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বেশি লভ্যাংশ প্রদানকারী কোম্পানি গ্রামীণফোনও রয়েছে। কোম্পানিটির আর্থিক বছর চূড়ান্ত হয় ডিসেম্বরে।

আলোচ্য সময়ে দুই শতাধিক কোম্পানির ঘোষিত নগদ লভ্যাংশের পরিমাণ ছয় হাজার কোটি টাকা, যা আগের আর্থিক বছরে ছিল সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা।

গত জুনে সমাপ্ত ২০২০-২১ আর্থিক বছরে টাকার অংকে লভ্যাংশ প্রদানের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে বিদ্যু-জ্বালানি খাতের কোম্পানি ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন। কোম্পানিটি এক আর্থিক বছরেই লভ্যাংশ বাবদ মোট ৯৮৫ কোটি টাকা বিতরণ করবে। উদ্যোক্তা, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারী এই লভ্যাংশ পাবেন। কোম্পানিটি উল্লিখিত বছরে ১৭০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। নিয়ম অনুযায়ী, বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) শেষে ঘোষিত লভ্যাংশ বিতরণ করা হয়। ইউনাইটেড পাওয়ারের এজিএম অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ২৭ ডিসেম্বর। এখনো প্রতিষ্ঠানটি ঘোষিত লভ্যাংশ বিতরণ সম্পন্ন করেনি। কোম্পানিটির শেয়ারের ৯০ শতাংশ আছে উদ্যোক্তাদের হাতে। বাকি ১০ শতাংশ শেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক, বিদেশি ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে। সেই হিসাবে কোম্পানিটির ঘোষিত লভ্যাংশের মধ্যে ৮৮৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা পাবেন উদ্যোক্তারা। আর বাকি সাড়ে ৯৮ কোটি টাকা লভ্যাংশ পাবেন প্রাতিষ্ঠানিক, বিদেশি ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

গত জুনে সমাপ্ত আর্থিক বছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লভ্যাংশ দিয়েছে ওষুধ খাতের কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। কোম্পানিটি আলোচ্য আর্থিক বছরের বিপরীতে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ৬০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। সে অনুযায়ী কোম্পানিটি লভ্যাংশ বাবদ ৫৩২ কোটি টাকা শেয়ারধারীদের মধ্যে বিতরণ করবে, যার সিংহভাগই পাবেন শেয়ারধারী প্রাতিষ্ঠানিক, বিদেশি ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

লভ্যাংশ বিতরণে তৃতীয় অবস্থানে আছে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ। দেশীয় কোম্পানিটি উদ্যোক্তা ও অন্য শেয়ারধারীদের মধ্যে লভ্যাংশ বাবদ প্রায় ৫১৭ কোটি টাকা বিতরণ করবে। এই লভ্যাংশের সিংহভাগই পাবেন কোম্পানিটির উদ্যোক্তারা। কারণ, এটির শেয়ারের ৯৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশই রয়েছে উদ্যোক্তাদের হাতে। বাকি শেয়ার রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক, বিদেশি ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। সেই হিসাবে লভ্যাংশ বাবদ বিতরণ করা ৫১৭ কোটি টাকার মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক, বিদেশি ও সাধারণ বিনিয়োগকারী পাবেন মাত্র ৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। বাকি ৫১০ কোটি টাকাই পাবেন উদ্যোক্তারা।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফার একটি অংশ লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণ করে। এই লভ্যাংশ পান সাধারণ শেয়ারধারীরা। লভ্যাংশ হিসেবে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যে অর্থ পান, তার একটি অংশ তাঁরা আবার শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন। ফলে দেখা যায়, কোম্পানিগুলো বছর শেষে যে লভ্যাংশ দেয়, তার একটি অংশ ঘুরেফিরে শেয়ারবাজারেই ফিরে আসে। লভ্যাংশের বাইরে শেয়ারের বাজারমূল্য বাড়লে তা থেকেও মুনাফা পান বিনিয়োগকারীরা।

ডিএসই, সিটি ব্রোকারেজ ও মার্চেন্ট ব্যাংক আইডিএলসির প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে সমাপ্ত ২০২০-২১ আর্থিক বছরের বিপরীতে দুই শতাধিক কোম্পানি নগদ লভ্যাংশ বাবদ মোট ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি শেয়ারধারীদের মধ্যে বিতরণের ঘোষণা দেয়। আগের ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে ঘোষিত লভ্যাংশের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে গত আর্থিক বছরে কোম্পানিগুলো আগের বছরের চেয়ে নগদ লভ্যাংশ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বেশি দিয়েছে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) নানাভাবে বোনাস লভ্যাংশ বিতরণ নিরুৎসাহিত করে আসছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে বোনাস লভ্যাংশকে নিরুৎসাহিত করতে করারোপ করা হয়। ওই অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা করেন, কোনো কোম্পানি বোনাস লভ্যাংশ দিলে তাকে ঘোষিত লভ্যাংশের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে। এ ছাড়া পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) নানাভাবে বোনাস লভ্যাংশ বিতরণ নিরুৎসাহিত করে আসছে। এর ফলে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে নগদ লভ্যাংশ প্রদানের আগ্রহ বেড়েছে, যার প্রতিফলন গত বছর দেখা গেছে।
এদিকে গত আগস্টে বিএসইসি লভ্যাংশ বিষয়ে একটি নির্দেশনা জারি করেছে। তাতে বলা হয়, কোম্পানির আধুনিকায়ন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার চাহিদা মেটাতে মূলধন বাড়ানোর বাধ্যবাধকতা পূরণ ও লাভজনক বিনিয়োগের জন্যই কেবল বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করা যাবে।

নগদ লভ্যাংশ বাবদ প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরা যে টাকা পান, তার বড় অংশই আবার শেয়ারবাজারে পুনর্বিনিয়োগ হয়। সেই অর্থে নগদ লভ্যাংশ শেয়ারবাজারের জন্য ভালো।
আবু আহমেদ, সাবেক অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নগদ লভ্যাংশ বাবদ প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরা যে টাকা পান, তার বড় অংশই আবার শেয়ারবাজারে পুনর্বিনিয়োগ হয়। সেই অর্থে নগদ লভ্যাংশ শেয়ারবাজারের জন্য ভালো। নগদ লভ্যাংশ ঘোষণার মধ্য দিয়ে কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পান বিনিয়োগকারীরা। বড় মূলধনি কোম্পানি বেশি নগদ লভ্যাংশ দেওয়া মানে ওই কোম্পানির ব্যবসা ভালো এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষও যথেষ্ট দক্ষ—সাধারণভাবে এটাই বোঝা যায়।

আবু আহমেদ আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা নানাভাবে বোনাস লভ্যাংশ প্রদান নিরুৎসাহিত করছে। এ কারণে কোম্পানিগুলোর মধ্যে নগদ লভ্যাংশ ঘোষণার আগ্রহ বেড়েছে। এই ধারা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকলে পুঁজিবাজারে পুনর্বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়বে। এই প্রবণতা বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।