সমন্বয়হীনতায় উৎকণ্ঠা সাধারণের

দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থা দুই নির্দেশনার জেরে আজ সোমবার বাজারে কী প্রতিক্রিয়া হয়, তা-ই এখন দেখার পালা।

দুই সংস্থার দুই নির্দেশনা

  • বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে শেয়ারবাজারে তাদের বিনিয়োগসংক্রান্ত তথ্য দিনে দিনে জানাতে হবে।

  • বিএসইসির নির্দেশনায় বলা হয়, ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৮ হাজার পয়েন্টে না যাওয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ ঋণসুবিধা পাবেন বিনিয়োগকারীরা।

শেয়ারবাজার নিয়ে এক দিনে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুই নির্দেশনা নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। নির্দেশনা দুটি জারি করেছে মুদ্রাবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

দুই সংস্থার দুই নির্দেশনা এক অর্থে পরস্পরবিরোধী। বাংলাদেশ ব্যাংক যে নির্দেশনা জারি করেছে, তাতে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আর সেই নেতিবাচক প্রভাব রোধে বিএসইসি সর্বোচ্চ ঋণ সুবিধা দিতে সূচকের সীমা ১ হাজার পয়েন্ট বাড়িয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে শেয়ারবাজারে তাদের বিনিয়োগসংক্রান্ত প্রতিদিনের তথ্য দিনে দিনে জানাতে হবে। ওই দিন বিষয়টি জানাজানি হয় দুপুরের পর। ততক্ষণে অবশ্য শেয়ারবাজারে লেনদেন শেষ। লেনদেন শেষ হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নির্দেশনা নিয়ে আলোচনা ও উদ্বেগ ছড়াতে থাকে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীসহ বাজারসংশ্লিষ্টদের মনে। সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমও সরব ছিল এ নিয়ে। সেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বার্তা দ্রুত পৌঁছে যায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কানে। বাজারের স্বার্থে তারাও জারি করল নতুন নির্দেশনা। বলা হলো প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৮ হাজার পয়েন্টে না যাওয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ (১০০ টাকার বিপরীতে ৮০ টাকা) ঋণসুবিধা পাবেন বিনিয়োগকারীরা। আগে সূচকের ৭ হাজার পয়েন্টের মধ্যে এ সুবিধা সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল।

এখন দেখার পালা দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থা দুই নির্দেশনার জেরে বাজারে কী প্রতিক্রিয়া হয়। তার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে আজ সোমবার দুপুর পর্যন্ত। তিন দিনের ছুটি শেষে আজ আবারও শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হবে। দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুই নির্দেশনার সুফল বা কুফল বর্তাবে বিনিয়োগকারীদের ওপর। তাঁরাই হবেন ভুক্তভোগী। ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে সবার। ওই ধসের পেছনে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমন্বয়হীনতা যেমন ছিল, তেমনি ছিল আইন পরিপালনের ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেমন বাজারের কারসাজি রোধ করতে পারেনি, তেমনি বাংলাদেশ ব্যাংকও আইন লঙ্ঘন করে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সামাল দিতে পারেনি। কোনো সংস্থা আইন লঙ্ঘনকারী কাউকে শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি।

২০১০ সালের ধসের পর বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসিসহ আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে গঠন করা হয় সমন্বয় কমিটি। শেয়ারবাজারের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সেই কমিটিতে আলোচনা হওয়ার কথা। কিন্তু আলোচনা তো দূরের কথা, সেই কমিটি নামে আছে, কাজে নেই।

এদিকে শেয়ারবাজার নিয়ে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এই বাজারকে সবাই মিলে ‘লজ্জাবতী লতা’ বানিয়ে রাখা হচ্ছে। রেখেছে। যেন ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না অবস্থা। কোনো ব্যাংক বা ব্যক্তি যদি আইন লঙ্ঘন করে বাজারে বিনিয়োগ করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে যেকোনো পর্যায় থেকে ব্যবস্থা নেওয়াই উচিত।

দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাম্প্রতিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ কী আসলে? উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি করা, নাকি অনিয়ম রোধ করে সুশাসন নিশ্চিত করা। ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে কী পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে, বিনিয়োগ করতে গিয়ে আইন লঙ্ঘন করেছে কি না, তা তো বাংলাদেশ ব্যাংকের অজানা থাকার কথা নয়। যদি সেই তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে না থাকে, তাহলে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকেরই নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা বা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। আর যদি থেকে থাকে, তাহলে সেই অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়াটাই শ্রেয়। চিঠি দিয়ে তথ্য তালাশ করে ভীতি ছড়ানোর কোনো দরকার নেই তার জন্য। বরং তাতে উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন জাগে।

এদিকে শেয়ারবাজার নিয়ে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এই বাজারকে সবাই মিলে ‘লজ্জাবতী লতা’ বানিয়ে রাখা হচ্ছে। রেখেছে। যেন ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না অবস্থা। কোনো ব্যাংক বা ব্যক্তি যদি আইন লঙ্ঘন করে বাজারে বিনিয়োগ করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে যেকোনো পর্যায় থেকে ব্যবস্থা নেওয়াই উচিত। তাতে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কী আছে। শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হয় কোম্পানির মৌল ভিত্তি দেখে। কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে তাতে কোম্পানির মৌল ভিত্তি তো আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। ব্যক্তি হোক বা প্রতিষ্ঠান, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ আসে ‘আত্মবিশ্বাস’ থেকে। বিনিয়োগকারীদের ‘আত্মবিশ্বাস’ বাড়ে স্বচ্ছতা ও সুশাসনে। সেখানে চিড় ধরলেই বরং বাজার নুইয়ে পড়ে। বরাবরই আমাদের বাজারের বড় সংকট স্বচ্ছতা ও সুশাসনের। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে শিথিলতাও সুশাসনের ঘাটতিরই অংশ।

বিএসইসির উচিত বাজারের নিয়মেই বাজারকে চলতে দেওয়া। পাশাপাশি কারসাজি রোধে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া। কারণ, কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়ানো হলে সেই দাম কখনো স্থায়ী হয় না।

বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংক থেকে প্রতিদিনের বিনিয়োগের তথ্য চেয়েছে। ধরে নিলাম, কাজটি প্রয়োজনের নিরিখেই করা হয়েছে। এ তথ্য এমন কোনো গোপনীয় তথ্য নয় যে লুকিয়ে তা সংগ্রহ করতে হবে বা লুকিয়ে রাখতে হবে। বরং নিয়ম করে এ বিনিয়োগের তথ্য ব্যাংকগুলোর ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো উপায়ে সপ্তাহ বা মাস ভিত্তিতে প্রকাশের ব্যবস্থা করা শ্রেয়। তাতে বরং স্বচ্ছতা বাড়বে।

আর বিএসইসির উচিত বাজারের নিয়মেই বাজারকে চলতে দেওয়া। পাশাপাশি কারসাজি রোধে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া। কারণ, কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়ানো হলে সেই দাম কখনো স্থায়ী হয় না। বর্তমানে ব্যাংকের সুদহার অনেক কম। সঞ্চয়পত্র ছাড়া সাধারণ মানুষের জন্য লাভজনক বিনিয়োগের আর কোনো ব্যবস্থা নেই। আবার করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা ভাব। তাই লাভের আশায় সবাই ছুটছেন শেয়ারবাজারে। টাকা ঢুকছে প্রতিনিয়ত। তাতে তরতর করে বাড়ছে সূচক। আর এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন কারসাজিকারকেরা। অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হচ্ছে কিছু শেয়ারের দাম। তাই এ সময়ে বিএসইসিকে কারসাজি রোধে আরও বেশি সতর্ক ও সক্রিয় হতে হবে, যাতে লাভের আশায় বাজারে আসা লোকজন অতীতের মতো নিঃস্ব হয়ে না ফেরেন। বিনিয়োগকারী তথা সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষাই যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থার লক্ষ্য হয়, তাহলে দুই সংস্থার সমন্বয়ে সমস্যা কোথায়? কেন দুই সংস্থার দুই বার্তা?