রিংশাইনের শেয়ার জালিয়াতির জন্য ১৩ জনের বিরুদ্ধে দুদকে চিঠি
জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা ছাড়া কোম্পানিটির শেয়ার ইস্যু করে এটির উদ্যোক্তা–পরিচালকসহ গুটিকয় লোক তা ভাগ–বাঁটোয়ারা করে নেন।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি রিংশাইন টেক্সটাইলের প্রাইভেট প্লেসমেন্ট ও আইপিও জালিয়াতির ঘটনার মূল হোতা আবদুল কাদের ফারুকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সম্প্রতি কমিশন সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আজ সোমবার বিএসইসির এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিএসইসি জানিয়েছে, আবদুল কাদের ফারুকসহ এ ঘটনায় জডিত মোট ১৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারির জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আবদুল কাদের ফারুক ছাড়া এ তালিকায় আছেন রিংশাইন টেক্সটাইলের ৯ বিদেশি মালিক, ভারতীয় নাগরিক অশোক কুমার চিরিমার, কোম্পানিটির আইপিও প্রসপেক্টাসে কোম্পানি সচিব এবং সিএফও হিসেবে স্বাক্ষর করা দুই ব্যক্তি। দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি তাঁদের সবার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ব্যবস্থা নিতে দুদককে চিঠি দিয়েছে বিএসইসি।
আবদুল কাদের ফারুক হলেন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত শার্প ইন্ডাস্ট্রিজ (একীভূত ও নাম বদল হওয়া সাবেক আরএন স্পিনিং) এবং ফার কেমিক্যাল নামক দুই কোম্পানির মূল উদ্যোক্তা। ২০১২ সালে আরএন স্পিনিং রাইট শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রমাণের পরও তৎকালীন এম খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন বিএসইসি তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এ ছাড়া রিংশাইন টেক্সটাইলের জালিয়াতির ঘটনায় অসত্য ও অতিরঞ্জিত আর্থিক প্রতিবেদনকে সঠিক বলে প্রত্যয়ন করায় ইস্যু ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান এএফসি ক্যাপিটাল এবং সিএপিএম অ্যাডভাইজরি নামে দুটি মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে শেয়ারবাজারসংক্রান্ত সব ধরনের কার্যক্রম থেকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে বিএসইসি। এ ছাড়া উভয় প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পাশাপাশি কোম্পানিটির ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ পর্যন্ত হিসাব বছরের মিথ্যা ও বানোয়াট আর্থিক বিবরণী অনুমোদনের অভিযোগে চারটি নিরীক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল বা এফআরসিতে অভিযোগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। যেসব নিরীক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো আহমেদ অ্যান্ড আখতার, শিরাজ খান বসাক, মাহফেল হক, এ টি এ খানসহ তাঁদের অংশীদার।
তবে আইপিওর আগে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধির কাজে ইস্যু ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বিএসইসি।
বিএসইসি সূত্র জানায়, আবদুল কাদের ফারুকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এরই মধ্যে দুদকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া রিংশাইন টেক্সটাইলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাং ওয়েই মিন, চেয়ারম্যান সাং জাই মিন, পরিচালক হ্যাং সিউ, হসিয়াও হাই হে, সাং ওয়েন লি অ্যাঞ্জেলা, সাং চাং ইয়াও, শিও ইয়েন শিন, হসিয়াও লিউ ই চি এবং চাক কওয়ানের বিরুদ্ধেও একই সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাঁরা যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন, সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বিএসইসি সূত্রে জানা যায়, রিংশাইনের জালিয়াতির ঘটনায় বিএসইসির পক্ষ থেকে তদন্ত হয়েছিল ২০২১ সালে। সেই তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বর্তমান কমিশন এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ২০২১ সালের জালিয়াতির এ ঘটনার তদন্তের পর বিএসইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন জালিয়াতির মাধ্যমে ইস্যু করা ২৭৫ কোটি টাকার শেয়ারের পুরোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেসব শেয়ার আর বাতিল হয়নি।
এদিকে মার্জিন ঋণের মাধ্যমে ২৯৬ কোটি টাকার মানি লন্ডারিং–সংক্রান্ত অনিয়মের কারণে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, পিএফআই সিকিউরিটিজ নামের ব্রোকারেজ হাউস এবং প্রাইম ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট নামের মার্চেন্ট ব্যাংকের তৎকালীন পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুদকে চিঠি পাঠানোরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যবস্থা গ্রহণেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি।
জানা যায়, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির আগে কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ বিদেশি ৯ উদ্যোক্তা, পরিচালকসহ শেয়ারবাজারের একটি চক্র এটির শেয়ার নিয়ে ব্যাপক জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। শেয়ার বিক্রি করে বাংলাদেশ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতে কোম্পানির হিসাবে কোনো টাকা না দিয়েই তারা ১৬১ কোটি টাকা মূল্যের শেয়ার নিজেদের নামে ইস্যু করে। কমিশনের তদন্তে বেরিয়ে আসে, প্রকৃতপক্ষে এ শেয়ার কিনতে তারা কোনো টাকা দেয়নি। এমনকি তালিকাভুক্তির পর লকইন বা বিক্রয় নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা উদ্যোক্তা–পরিচালকদের শেয়ার কোনো ঘোষণা ছাড়া বিক্রি করে দেয়। উদ্যোক্তাদের বাইরে আরও ৩৩ বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও টাকা ছাড়া প্রাইভেট প্লেসমেন্টে শেয়ার নিয়েছেন বলে বিএসইসির তদন্তে বেরিয়ে এসেছিল।