মূল ব্যবসায় লোকসান, ভরসা সুদ আয়

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) মূল ব্যবসার বদলে এখন আয়ের প্রধান উৎস সুদ আয়। তিন বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির মূল ব্যবসার আয় কমেছে। সর্বশেষ গত ২০২৪–২৫ অর্থবছরে স্টক এক্সচেঞ্জটির মূল ব্যবসার আয় আগের অর্থবছরের চেয়ে ৭ কোটি টাকার বেশি বা প্রায় ২৩ শতাংশ কমে গেছে।

২০২৪–২৫ অর্থবছরে মূল ব্যবসার বিভিন্ন খাত থেকে সিএসই আয় করেছে ২৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। তার আগের ২০২৩–২৪ অর্থবছরে এই খাত থেকে সংস্থাটি আয় করেছিল ৩১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। দেশের দ্বিতীয় শেয়ারবাজার সিএসইর মূল ব্যবসায়িক আয়ের খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে শেয়ার কেনাবেচাসংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে কমিশন প্রাপ্তি, তালিকাভুক্তির মাশুল, ব্রোকারেজ হাউস বা ট্রেক নবায়ন ও বিভিন্ন সেবামাশুল। এসব উৎসের মধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জের আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস হলো লেনদেন বাবদ পাওয়া কমিশন ও তালিকাভুক্তির ফি। গত অর্থবছরে দুটি খাতেই ছিল মন্দাবস্থা। নতুন কোম্পানি ও সিকিউরিটিজ খুব বেশি তালিকাভুক্ত হয়নি। পাশাপাশি বাজারে মন্দাবস্থার কারণে লেনদেনও কমে গিয়েছিল। ফলে উভয় খাত থেকে সিএসইর আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। সংস্থাটির সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০২৪–২৫ অর্থবছরে লেনদেনের কমিশন থেকে সিএসইর আয় হয়েছে ৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা, যা তার আগের ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ছিল সাড়ে ৭ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরে স্টক এক্সচেঞ্জটির লেনদেনের কমিশন বাবদ আয় ৩ কোটি ২১ লাখ টাকা বা প্রায় ৪৩ শতাংশ কমেছে। গত অর্থবছরে তালিকাভুক্তির মাশুল বাবদ প্রতিষ্ঠানটি আয় করেছে ১৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এই আয় আগের অর্থবছরে ছিল ২২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। সেই হিসাবে এক বছরে স্টক এক্সচেঞ্জটির মূল ব্যবসা তথা তালিকাভুক্তির মাশুল বাবদ আয় ৪ কোটি টাকা বা প্রায় ১৮ শতাংশ কমেছে। সিএসইর ব্যবসার প্রধান দুই খাত থেকে এক বছরে আয় কমেছে প্রায় সোয়া ৭ কোটি টাকা। তাতে পরিচালন আয় গত বছরের চেয়ে কমে গেছে।

তবে পরিচালন আয় যতটা কমেছে, ব্যয় ততটা কমেনি সংস্থাটির। ফলে বছর শেষে প্রায় ১৫ কোটি টাকা পরিচালন লোকসান গুনতে হয়েছে দেশের দ্বিতীয় এই স্টক এক্সচেঞ্জটিকে। আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ২৪ কোটি টাকার পরিচালন আয়ের বিপরীতে সিএসইর পরিচালন ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩৯ কোটি টাকা। তার আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩২ কোটি টাকার পরিচালন আয়ের বিপরীতে সংস্থাটির পরিচালন খরচ হয়েছিল প্রায় সোয়া ৪২ কোটি টাকা। তাতে সে অর্থবছরে সিএসইর পরিচালন লোকসান হয় ১০ কোটি টাকার বেশি। সর্বশেষ গত ২০২৪–২৫ অর্থবছরে এই লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ কোটি ৬০ লাখ বা ১৫ কোটি টাকার কাছাকাছি।

কয়েক বছর ধরে শেয়ারবাজারের সার্বিক যে মন্দাবস্থা, তারই প্রভাব আমাদের আয়েও পড়েছে। বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব ধরনের প্রতিষ্ঠানই বর্তমান বাজার থেকে তেমন মুনাফা করতে পারছে না।
সাইফুর রহমান মজুমদার, এমডি, সিএসই

পরিচালন লোকসানের পরও গত অর্থবছর শেষে সিএসই প্রায় ২৯ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যার বড় অংশই এসেছে সুদ ও লভ্যাংশ বাবদ আয় থেকে। গত অর্থবছরে সিএসই সরকারি বিভিন্ন বিল–বন্ডের বিনিয়োগ ও ব্যাংকে রাখা স্থায়ী আমানত থেকে ৫০ কোটি টাকার বেশি সুদ আয় করেছে। এ ছাড়া সিডিবিএল ও সিসিবিএলের বিনিয়োগের বিপরীতে লভ্যাংশ, ভবন ও জায়গা ভাড়াসহ বিভিন্ন খাত থেকে আয় করেছে প্রায় সোয়া ৭ কোটি টাকা। লভ্যাংশ ও সুদ বাবদ বড় অঙ্কের আয়ের ফলে বছর শেষে সিএসই ২৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকার কর–পরবর্তী মুনাফা করেছে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৩১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে প্রতিষ্ঠানটির কর–পরবর্তী মুনাফা প্রায় ৩ কোটি টাকা কমেছে।

আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন অর্থবছর ধরে সংস্থাটির মুনাফা ধারাবাহিকভাবে কমেছে। যেমন ২০২১–২২ অর্থবছরে সংস্থাটির কর–পরবর্তী মুনাফার পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৯ কোটি টাকা, যা ২০২২–২৩ অর্থবছরে তা কমে সাড়ে ৩৪ কোটি টাকায়, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে প্রায় ৩২ কোটি টাকায় ও সর্বশেষ ২০২৪–২৫ অর্থবছরে আরও কমে ২৯ কোটি টাকায় নেমেছে। এই মুনাফা কমেছে মূলত সংস্থাটির মূল ব্যবসার আয় ধারাবাহিকভাবে কমে যাওয়ার কারণে। সিএসইর গত কয়েক বছরের আর্থিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২১–২২ অর্থবছরে মূল ব্যবসা থেকে সংস্থাটির আয় হয়েছিল ৩৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এরপর ২০২২–২৩ অর্থবছরে তা কমে সাড়ে ৩৫ কোটি টাকায়, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ৩২ কোটি টাকায় এবং সর্বশেষ অর্থবছরে আরও কমে প্রায় সাড়ে ২৪ কোটি টাকায় নেমেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাইফুর রহমান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে শেয়ারবাজারে সার্বিকভাবে যে মন্দাবস্থা চলছে, তারই প্রভাব পড়েছে আমাদের আয়ে। বাজারের এখন যে অবস্থা তাতে শুধু স্টক এক্সচেঞ্জ নয়, বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব ধরনের প্রতিষ্ঠানই বর্তমান বাজার থেকে তেমন মুনাফা করতে পারছে না। নতুন কোম্পানি বাজারে আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অতীতে যেসব বাজে কোম্পানি বাজারে এসেছে, সেগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। সব মিলিয়ে বাজারে বিনিয়োগকারী থাকলেও মন্দাবস্থার কারণে তাদের বড় অংশই নিষ্ক্রিয়। বাজারের গুণগত পরিবর্তন খুব একটা হয়নি। ফলে বাজার বড় হওয়ার বদলে সংকুচিত হয়েছে। এ কারণে আমাদের পরিচালন লোকসান গুনতে হয়েছে। তবে হাতে থাকা উদ্বৃত্ত তারল্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমরা মুনাফা ধরে রাখতে পেরেছি।’

কেন পরিচালন লোকসান

সিএসইর মূল ব্যবসার প্রধান আয় হলো লেনদেন থেকে পাওয়া কমিশন। লেনদেন কমে যাওয়ায় সংস্থাটির মূল ব্যবসা থেকে আয়ও কমে গেছে। আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে চট্টগ্রামের শেয়ারবাজারে দৈনিক গড় লেনদেন সবচেয়ে কম ছিল গত অর্থবছরে। গত অর্থবছর শেষে এই বাজারে দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১৭ কোটি টাকা। তার আগে ২০২৩–২৪, ২০২২–২৩, ২০২১–২২ ও ২০২০–২১ অর্থবছরে সিএসইতে দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩১, ২৫, ৫০ ও ৪৭ কোটি টাকা।

স্টক এক্সচেঞ্জের আয়ের আরেকটি বড় উৎস তালিকাভুক্তির মাশুল। এ ক্ষেত্রে দুভাবে মাশুল আদায় করে স্টক এক্সচেঞ্জ। প্রথমত নতুন তালিকাভুক্তির মাশুল, দ্বিতীয়ত তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বার্ষিক মাশুল। গত ২০২৪–২৫ অর্থবছরে সিএসইর মূলবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে মাত্র একটি সিকিউরিটিজ। অথচ এর আগের অর্থবছরে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজের সংখ্যা ছিল ১১টি। তালিকাভুক্তি কমে যাওয়ায় আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানি বন্ধ হওয়া ও লোকসানে পড়ায় সেগুলো থেকে বার্ষিক মাশুল আদায় করা কঠিন হয়ে গেছে।