শেয়ারবাজারে সংকট চলছে, নতুন কর নয়: ডিএসই

ডিএসইর দাবি

  • লেনদেনের ওপর ধার্য কর শূন্য দশমিক ০৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ০২ শতাংশ করা।

  • তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট কর কমিয়ে সাড়ে ১৭ শতাংশ নির্ধারণ।

বাজেট সামনে রেখে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা। গতকাল রাজধানীর ঢাকা ক্লাবেছবি: বিজ্ঞপ্তি

শেয়ারবাজারে এখন ‘ক্রান্তিকাল বা সংকট কাল’ চলছে বলে মন্তব্য করেছে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ। এ সময় তাই শেয়ারবাজারে নতুন করে কোনো করের বোঝা চাপালে তা বাজারকে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে মনে করে সংস্থাটি। এ জন্য শেয়ারবাজারের নানা খাতে আরোপিত কর কমানোর পাশাপাশি মূলধনি মুনাফার ওপর এ মুহূর্তে করারোপ না করার দাবি জানিয়েছে ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে আয়োজিত প্রাক্‌-বাজেট সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের পক্ষে এ দাবি জানান সংস্থাটির চেয়ারম্যান হাফিজ মো. হাসান বাবু। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি করসংক্রান্ত পাঁচটি দাবি তুলে ধরেন।

বাজেট সামনে রেখে ডিএসই আয়োজিত এক প্রাক্‌–বাজেট সংবাদ সম্মেলনে গতকাল মঙ্গলবার এ দাবি জানানো হয়।

এসব দাবির মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের মূলধনি মুনাফার (শেয়ার বিক্রি করে যে মুনাফা করা হয়) ওপর নতুন করে কোনো করারোপ না করা, ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেনের ওপর আরোপিত উৎসে কর কমানো, তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট করহারের ব্যবধান ন্যূনতম ২০ শতাংশে উন্নীত করা, ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত লভ্যাংশ আয়কে করমুক্ত রাখা, লভ্যাংশ বিতরণকালে কোম্পানিগুলো যে উৎসে কর কেটে রাখে, সেটি চূড়ান্ত কর দায় হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া ও সব ধরনের বন্ড থেকে প্রাপ্ত আয়কে করমুক্ত রাখা। এসব দাবির পক্ষে নানা যুক্তিও তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে।

মূলধনি মুনাফার ওপর নতুন করে করারোপ না করার যুক্তি হিসেবে ডিএসই বলছে, শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ৯০ শতাংশই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। তাদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালক, প্লেসমেন্ট শেয়ারধারী, স্টক ব্রোকার, ডিলারসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সবাই মূলধনি মুনাফার ওপর সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হারে কর দেন। মূলধনি মুনাফার ওপর কর দেন না শুধু ব্যক্তি শ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা, যা শেয়ারবাজারের মোট বিনিয়োগকারীর মাত্র ১০ শতাংশ। এসব সাধারণ বিনিয়োগকারীর মূলধনি মুনাফার ওপর নতুন করে করারোপ করা হলে তাতে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। লেনদেন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাতে সার্বিকভাবে শেয়ারবাজার থেকে সরকারের রাজস্ব আয় না বেড়ে উল্টো কমে যেতে পারে।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর সূত্রের বরাতে বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছর থেকে শেয়ারবাজারে ৪০ লাখ টাকার বেশি মূলধনি মুনাফার ক্ষেত্রে করারোপের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এ নিয়ে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে অনুষ্ঠিত দেশের ব্যবসায়ীদের এক বৈঠকেও শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপ না করার আহ্বান জানানো হয়।

এদিকে ডিএসইর পক্ষ থেকে আগামী বাজেটে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট করহারে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরির দাবি তোলা হয়েছে। সংস্থাটি প্রস্তাব করেছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে করপোরেট কর কমিয়ে সাড়ে ১৭ শতাংশ করার। আর অতালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে তা বাড়িয়ে সাড়ে ৩৭ থেকে ৪০ শতাংশ করার। যুক্তি হিসেবে ডিএসই বলছে, করের হারের ব্যবধান বাড়ানো হলে তাতে ভালো কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে বেশি আগ্রহী হবে। তাতে রাজস্ব আদায় কমবে না, বরং বাড়বে। কারণ, আইনকানুন পরিপালন ও সুশাসন চর্চায় তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো অতালিকাভুক্ত কোম্পানির চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছ। বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে করপোরেট করহার ২০ শতাংশ আর অতালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে এ হার সাড়ে ২৭ শতাংশ।

এ ছাড়া ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেনের ওপর ধার্য কর (টার্নওভার ট্যাক্স) শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক শূন্য ২ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে ডিএসই। সংস্থাটি বলছে, ২০১৫ সালেও লেনদেনের ওপর উৎসে করহার ছিল শূন্য দশমিক শূন্য ১৫ শতাংশ। কর বাড়িয়ে এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় খুব বেশি বাড়েনি। বরং কর কমিয়ে শেয়ারবাজারে লেনদেন বাড়লে তাতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে।

প্রশ্নোত্তর পর্ব

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা জানতে চান, শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য কি শুধু করারোপের উদ্যোগই দায়ী, নাকি আস্থার ঘাটতিই বড় কারণ? জবাবে ডিএসইর চেয়ারম্যান বলেন, ‘শেয়ারবাজারে আস্থার সংকট রয়েছে। করোনা–পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দাবস্থার কারণে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, সেখান থেকে আমরা বের হতে পারিনি। এককভাবে এ পরিস্থিতির জন্য কেউ হয়তো দায়ী নয়, কিন্তু সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে শেয়ারবাজারে ক্রান্তিকাল চলছে।’

এ সময় তালিকাভুক্ত কোম্পানির সুশাসন ও বাজারের কারসাজি বন্ধে ডিএসইর ব্যর্থতা নিয়েও প্রশ্ন করেন এক সাংবাদিক। জবাবে ডিএসইর পক্ষ থেকে বলা হয়, ডিএসইর পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তারপরও বলব, বাজারে তদারকি বাড়াতে ও ডিএসইর ভূমিকাকে কার্যকর করতে হলে সংস্থাটির আরও বেশি ক্ষমতায়ন দরকার। বর্তমানে নানা ক্ষেত্রে আইনি সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ডিএসইর পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম, মোহাম্মদ শাহজাহান, শরীফ আনোয়ার হোসেন, রিচার্ড ডি রোজারিও, ভারপ্রাপ্ত এমডি সাত্ত্বিক আহমেদ শাহ, প্রধান নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা খায়রুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদ প্রমুখ।