সংকটেও যেভাবে মুনাফা বাড়াল সিমেন্ট ও রডের দুই কোম্পানি

ডলার-সংকট ও অর্থনীতির ধীরগতির মধ্যেও তিন কারণে দারুণভাবে মুনাফায় ফিরেছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সিমেন্ট ও রড উৎপাদনকারী একাধিক কোম্পানি। সম্প্রতি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সিমেন্ট ও ইস্পাত খাতের দুটি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। মূলত তিন কারণে কোম্পানিগুলো ভালো মুনাফায় ফিরেছে। সেগুলো হলো পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম কমে যাওয়া ও বিক্রি বেড়ে যাওয়া।

ডলার-সংকটের কারণে গত বছরের শেষভাগে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আমদানিনির্ভর উৎপাদন খাতের কোম্পানিগুলো বড় ধরনের সংকটে পড়ে। বিশ্ববাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও দেশে ডলারের উচ্চ মূল্যের কারণে এসব কোম্পানির মুনাফা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। কিন্তু বছর না ঘুরতেই সেই সংকট কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে কোম্পানিগুলো।

সম্প্রতি চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশের ইস্পাত খাতের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি বিএসআরএম ও সিমেন্ট খাতের কোম্পানি প্রিমিয়াম সিমেন্ট। তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রিমিয়ার সিমেন্টের শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস ২১ গুণ বেড়েছে। একই সময়ে ইস্পাত খাতের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি বিএসআরএমের ইপিএস বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। অথচ এ সময়ে দুই কোম্পানিই ডলারের উচ্চ মূল্যের কারণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মুনাফা হারিয়েছে।

প্রিমিয়ার সিমেন্টের মুনাফায় বড় উত্থান
 আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চে কোম্পানিটি ৬০২ কোটি টাকা আয় করেছে। গত বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৪২৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির আয় ৪১ শতাংশ বেড়েছে। এ আয় বেড়েছে মূলত বিক্রি ও বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম কমার কারণে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলার-সংকটের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এরপর সিমেন্টের দাম কিছুটা বাড়ানো হলেও তা ছিল উৎপাদন খরচের তুলনায় কম। এ অবস্থায় বিক্রি বাড়ানোর প্রতি জোর দেয় কোম্পানিটি। তাতে ছয় মাসের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ায় প্রিমিয়ার সিমেন্ট।

কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের শেষ ছয় মাসে; অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বরে প্রিমিয়ার সিমেন্ট ২৬ কোটি টাকা লোকসান করে। ৯ মাসে এসে সেই লোকসান কাটিয়ে মুনাফায় ফিরেছে কোম্পানিটি। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ প্রান্তিক শেষে; অর্থাৎ ৯ মাসে প্রিমিয়ার সিমেন্টের মুনাফা বেড়ে হয়েছে ৪৯ কোটি টাকা। যদিও এ সময়ে ডলারের উচ্চ মূল্যের কারণে কোম্পানিটি ৬৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে। কোম্পানি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডলারের বাড়তি দামের কারণে বড় অঙ্কের লোকসান না হলে মুনাফা আরও বেশি হতো।

আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, উল্লিখিত ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) প্রিমিয়ার সিমেন্ট ২০ লাখ টন সিমেন্ট বিক্রি করেছে। আগের বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ টন। তাতে কোম্পানিটির আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৭ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম কমায় উৎপাদন খরচ কমেছে ৪ শতাংশের বেশি। ফলে মুনাফায় তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

বিএসআরএমের আয় বেড়েছে ৬৬%
সর্বশেষ জানুয়ারি-মার্চের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ইস্পাত খাতে শীর্ষস্থানীয় এ কোম্পানির আয় বেড়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানু-মার্চ) কোম্পানিটি পণ্য বিক্রি করে আয় করেছে ৩ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির আয় বেড়েছে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। এতে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটির মুনাফা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬০ কোটি টাকায়। গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ১১৮ কোটি টাকা।  

জানতে চাইলে বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, মূলত রডের মূল্যবৃদ্ধি ও বিক্রি বাড়ার কারণে কোম্পানিটির আয় বেড়েছে।

জানা গেছে, গত মার্চে প্রতি টন রডের দাম বেড়ে লাখ টাকা ছাড়ায়। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এক বছরে রডের (৬০ গ্রেড) দাম টনপ্রতি ১০ হাজার টাকা বেড়েছে। গত বছরের ৩১ মার্চ প্রতি টন রডের সর্বোচ্চ দাম ছিল ৯১ হাজার ৫০০ টাকা। চলতি বছরের ৩১ মার্চ সেই দাম বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৫০০ টাকা। আর তাতেই আয় ও মুনাফা বেড়েছে বিএসআরএমের।

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ভালো মুনাফা করলেও গত বছরের শেষ ছয় মাসে ডলারের উচ্চ মূল্য ও বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিটির ব্যবসা ভালো যায়নি। সেই কারণে ৯ মাসের (জুলাই-মার্চ) হিসাবে মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৪৪ কোটি টাকায়। কারণ, গত বছরের জুলাই-ডিসেম্বরে কোম্পানিটি ১১৬ কোটি টাকা লোকসান করেছিল। সেই লোকসান কাটিয়ে মার্চ শেষে কোম্পানিটি আবার মুনাফায় ফিরেছে।