বে লিজিংয়ের ৯ মাসের মুনাফা মিলিয়ে গেল বছর শেষে

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ৯ মাসের মুনাফা হারিয়ে গেল শেষ তিন মাসে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর প্রতি প্রান্তিকে কোম্পানিটির মুনাফা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। আর মুনাফা বৃদ্ধির খবরে গত বছর কোম্পানিটির শেয়ারের দামও বেশ বেড়েছে। কিন্তু বছর শেষে জানা গেল কোম্পানিটি বড় অঙ্কের লোকসান করেছে। এতে বছর শেষে এটির শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস কমে ৯৯ পয়সা ঋণাত্মক হয়ে গেছে। অর্থাৎ বছর শেষে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ৯৯ পয়সা লোকসান করেছে।

কোম্পানিটির আয়ের ক্ষেত্রে কেন এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল, তা খুঁজে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। গত বৃহস্পতিবার এ কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে বিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক কাওসার আলীকে। সদস্য করা হয়েছে উপপরিচালক কাজী মো. আল ইসলাম ও সহকারী পরিচালক মো.আতিকুর রহমানকে। কমিটিকে ২০ কার্যদিবসের মধ্যে তাঁদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যানুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে বে লিজিংয়ের ইপিএস ছিল ৩১ পয়সা। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ইপিএস আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯ পয়সায়। আর জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ১ টাকা ৯৫ পয়সা। এভাবে গত বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে ধারাবাহিকভাবে মুনাফা বেড়েছে কোম্পানিটির। এই তিন প্রান্তিকেই কোম্পানিটি মুনাফার যে হিসাব প্রকাশ করেছিল, সেটি অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। মুনাফা বৃদ্ধির এসব তথ্যের ভিত্তিতে গত বছরের শুরু থেকে কোম্পানিটির শেয়ারের দামেরও হেরফের হয়। গত বছরের ৪ এপ্রিল কোম্পানিটির শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ১৮ টাকা ৬০ পয়সা। ওই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর তা বেড়ে সর্বোচ্চ ৩৭ টাকায় উঠেছিল। গত বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল প্রায় ২৪ টাকা।

সর্বশেষ ১৫ সেপ্টেম্বর বে লিজিং গত বছর শেষে আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য প্রকাশের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করে। সেখানে কোম্পানিটি জানিয়েছে, ২০২১ সাল শেষে কোম্পানির ইপিএস দাঁড়িয়েছে ৯৯ পয়সা ঋণাত্মক। অথচ জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর—এই ৯ মাসে কোম্পানিটির ইপিএস ছিল ২ টাকা ৭৫ পয়সা, বছর শেষে যা ঋণাত্মক হয়ে যায়।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে ইপিএস খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য। একটি কোম্পানি একটি নির্দিষ্ট সময়ে যে পরিমাণ আয় করে, সেখান থেকে সব ধরনের খরচ ও কর বাদ দেওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে, তা ওই কোম্পানির মুনাফা। ওই মুনাফাকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ারসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস হিসাব করা হয়। তাই মুনাফা বৃদ্ধি বা কমার তথ্যে শেয়ারের দামও ওঠানামা করে।

বে লিজিংয়ের বছর শেষে ইপিএস কমে যাওয়ার তথ্য প্রকাশের পর তা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নানা ধরনের সন্দেহ দেখা দেয়। তীব্র সমালোচনাও শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি।

বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত কমিটিকে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ বা কার্যপরিধি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে কোম্পানিটির গত এক বছরের নিরীক্ষিত ও অনিরীক্ষিত সব আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে সেখানে কোনো ধরনের আর্থিক কারসাজি করা হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন প্রান্তিকে কোম্পানিটির মুনাফা বা ইপিএসের তারতম্যের সঙ্গে বাজারে শেয়ারের দামের কী ধরনের তারতম্য ঘটেছে, তা খতিয়ে দেখা। উল্লেখিত সময়ে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ইনসাইডার ট্রেডিং, অর্থাৎ সুবিধাভোগী লেনদেন হয়েছে কি না, তা খুঁজে বের করা। পাশাপাশি কোম্পানিটির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনিয়ম ঘটেছে কি না, তা খতিয়ে দেখা।

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনেক সময় কোম্পানির সুবিধাভোগীরা নিজেদের স্বার্থে ইপিএস কমিয়ে-বাড়িয়ে দেখান। ইপিএস নিয়ে কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দামকে প্রভাবিত করেন অনেক উদ্যোক্তা। এর মাধ্যমে তাঁরা বাজার থেকে নিজেরা লাভবান হন। আর ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বে লিজিং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০০৯ সালে। ২০২১ সালের জন্য কোম্পানিটি শেয়ারধারীদের ৫ শতাংশ হারে স্টক বা বোনাস লভ্যাংশ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে ঘোষিত লভ্যাংশের মধ্যে এটিই সর্বনিম্ন। অর্থাৎ গত এক যুগের মধ্যে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে কম লভ্যাংশ দিচ্ছে গত বছর।