গাছতলায় জন্ম যে শেয়ারবাজারের

শেয়ারবাজারপ্রতীকী ছবি

আক্ষরিক অর্থেই গাছতলায় জন্ম হয়েছিল বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শেয়ারবাজার নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার মাত্র ১৬ বছর পরেই জন্ম হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠানের, আজকের বিশ্ব অর্থনীতিতে যার গুরুত্ব অপরিসীম।

দিনটি ছিল ১৭ মে, ১৭৯২ সাল। সেদিন ওয়াল স্ট্রিটে একটি বাটনউডগাছের তলায় হাজির হয়েছিলেন নিউইয়র্কের ২৪ জন দালাল ও মার্চেন্ট। লোয়ার ম্যানহাটানে সেটিই ছিল সবচেয়ে বড় গাছ। এই গাছ সিকামোর নামেও পরিচিত। ওই ২৪ জন সেদিন একটি চুক্তিতে সই করেন, ইতিহাসে যেটি পরিচিতি পায় ‘বাটনউড অ্যাগ্রিমেন্ট’ নামে।

নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের সেটিই ছিল ভিত্তি। সেদিন ওই ব্রোকার বা দালালেরা যে চুক্তিতে সই করেন, তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নিউইয়র্ক স্টক অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড। ১৮৬৩ সালে সংক্ষিপ্ত হয়ে এর নাম হয় নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্র ও বৈশ্বিক অর্থনীতির জগতে এই শেয়ারবাজার এখন বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছে।

ওয়াল স্ট্রিটেরও বড় পরিবর্তন হয়েছে। এটি বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক কেন্দ্র। সেই বাটনউডগাছটি আর নেই। তবে সেই গাছের স্মরণে স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ নতুন একটি বাটনউডগাছ লাগিয়েছে। পুরোনো সেই গাছের মতো এটি বড় নয়। কিন্তু এটি বাটনউড চুক্তি স্বাক্ষরের সেই ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

কী ছিল চুক্তিতে

বাটনউড চুক্তিটি ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। মাত্র দুটি বাক্যে এই চুক্তি শেষ করা হয়। মূলত দুটি শর্ত ছিল এই চুক্তিতে। প্রথমত, স্টক এক্সচেঞ্জের দালালেরা শুধু নিজেদের মধ্যেই লেনদেন করবেন; এবং দ্বিতীয়ত, লাভ বা ক্ষতি যা-ই হোক না কেন, গ্রাহকদের কাছ থেকে তাঁরা লেনদেন মূল্যের ওপর নির্দিষ্টভাবে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে কমিশন নেবেন।

একেবারে সরল-সোজা চুক্তিটি খুবই কার্যকর হয়েছিল। এর ফলে গ্রাহকেরা লেনদেনে আস্থা ফিরে পান। একই সঙ্গে স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যপদ লাভজনক হয়ে দাঁড়ায়। এই লাভের কারণেই সদস্যরা নিয়মকানুন মানতে উৎসাহী হন। দেখা গেল নিয়মকানুন মানলেই বরং স্রোতের মতো কমিশন আসছে। একই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অর্থে প্রবেশাধিকার তো ছিলই।

বাটনউড চুক্তি মূলত তৎকালীন ইউরোপীয় বাণিজ্য ব্যবস্থার আদলে কিছু নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠা করেছিল। এর প্রয়োজন হয়েছিল, কারণ ১৭৯২ সালেই যে ফাইন্যান্সিয়াল প্যানিক বা আর্থিক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে আস্থা ফিরিয়ে আনা ছিল জরুরি। ব্রোকার বা দালাল এবং মার্চেন্টদের মধ্যে ওই আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। চুক্তিটি সেই ঘাটতি পূরণ করে।

কেন আস্থার ঘাটতি

১৭৯২ সালে তৈরি হয়েছিল ঋণ করার সংকট। সে সময় নিরাপদে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে খুব কঠোর কোনো নিয়মকানুন ছিল না। অনেক ব্যবসায়ীই লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতেন। আর্থিক বাজারে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য যদি কাউকে দায়ী করতে হয়, তাহলে তিনি ছিলেন উইলিয়াম ডুয়ের। ফাটকাবাজি করার জন্য পরিচিত ছিলেন তিনি। কেনাবেচার জন্য প্রচুর ধার করেছিলেন।

কিন্তু একসময় তাঁর ধারের পরিমাণ এত বেশি হয় যে তিনি আর ঋণ শোধ করতে পারছিলেন না। তাকে সবকিছু বেচে দিতে হয়। সমস্যা তাতেও শেষ হয়নি। ঋণ পুরোপুরি শোধ করার ব্যাপারে তাঁর ব্যর্থতা রীতিমতো সংকটের জন্ম দেয়। ফলে অর্থমন্ত্রী আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে এগিয়ে আসতে হয়। অর্থনীতির স্বার্থে তিনি অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে অর্থ জোগান দেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সেই প্রথম ব্যাংক বেইল আউট করা হয়।

২৪ জন দালাল ও মার্চেন্ট মিলে এ চুক্তির মাধ্যমে ১৭৯২ সালে শুরু করেন নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের কার্যক্রম
ছবি: সংগৃহীত

ওই সংকটের প্রতি সাড়া হিসেবেই ওয়াল স্ট্রিটের সেই ২৪ জন ব্রোকার ও মার্চেন্ট বাটনউড চুক্তি করেন, যাতে তাঁরা নিজেদের মধ্যে লেনদেন ও নির্দিষ্ট কমিশন নেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে আস্থা ফিরিয়ে আনেন। এর মাধ্যমে তাঁরা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেন, যেখানে সবাই সবাইকে বিশ্বাস করেন।

এমনকি আজও আর্থিক খাত হলো একমাত্র ব্যবসা, যেখানে দুজন ব্যবসায়ী কেবল হ্যান্ডশেক করেই শত শত কোটি ডলারের লেনদেন করতে পারেন। এর জন্য পণ্য দেখানোর প্রয়োজন হয় না।

মজার বিষয় হলো, বাটনউড চুক্তির আওতায় প্রথম যে শেয়ারটি লেনদেন করা হয়েছিল, সেটি ছিল ব্যাংক অব নিউইয়র্কের। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন।

প্রথম দিকের কথা

নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের প্রথম দিকের লেনদেন হতো অনেকটা অনানুষ্ঠানিকভাবে। কাছের এক কফিহাউসে সবাই একত্র হতেন, সেখানেই চলত লেনদেন। ১৮১৭ সালে শেয়ারবাজার বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে ব্রোকাররা মনে করেন, আনুষ্ঠানিক কাঠামো দরকার। ওই বছরের ৮ মার্চ একটি গঠনতন্ত্র পাস করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় নিউইয়র্ক স্টক অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড।

ঠিক করা হয়, নিয়মকানুন ভাঙলে জরিমানা করা হবে। ৪০ নম্বর ওয়াল স্ট্রিটে একটি রুম ভাড়া নেওয়া হয়। সেখানে দালালেরা প্রতিদিন দুবার জমায়েত হতেন। তখন লেনদেন করার জন্য তাদের হাতে ছিল ৩০টি শেয়ার ও বন্ড। এক্সচেঞ্জের প্রেসিডেন্ট পোডিয়াম থেকে প্রতিটি শেয়ারের নাম ধরে চিৎকার করতেন। ব্রোকাররা তাদের জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে পাল্টা চিৎকার করে শেয়ারের দাম জানাতেন। সেখান থেকেই শেয়ারবাজারে ‘সিট’ শব্দটির উৎপত্তি এবং স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যপদের বিষয়টি এর মাধ্যমেই বোঝানো হয়।

নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের শুরু হয়েছিল পাঁচটি সিকিউরিটিজ নিয়ে—তিনটি সরকারি বন্ড আর দুটি ব্যাংকের শেয়ার। এখন প্রতিদিন শত শত কোটি ডলারের শেয়ার বিক্রি হয় এখানে। প্রথমবারের মতো ১০ লাখ শেয়ার বিক্রি হয়েছিল ১৮৮৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর। ২০২২ সালে এসে প্রতিদিন ৫০০ কোটির বেশি শেয়ার হাতবদল হতে শুরু করে।

শুরু আর শেষের বেল

প্রতিদিন বেল বাজিয়ে স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন শুরু ও শেষ হয়। আমেরিকার পূর্বাঞ্চলীয় সময় ঠিক সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে বাজে শুরুর বেল। শেষ বেল চারটায়। কিন্তু বেলের ব্যবহার শুরু হয় অনেক পরে। প্রথম দিকে ছিল একটি হাতুড়ি। বোর্ডের ওপর সেটি ঠুকে লেনদেন শুরুর সংকেত দেওয়া হতো। ১৮০০ সালের শেষ দিকে ব্যবহার হতো ঘণ্টা। চীনা ঘণ্টা যেমন দেখা যায়। বেলের ব্যবহার শুরু ১৯০৩ সালে, যখন স্টক এক্সচেঞ্জ ১৮ ব্রড স্ট্রিটে চলে যায়।

১৯৯৫ সালের আগপর্যন্ত একজন ফ্লোর ম্যানেজার বেল বাজানোর দায়িত্বে ছিলেন। এরপর কর্তৃপক্ষ প্রায়ই কোম্পানি নির্বাহীদের ডাকতেন বেল বাজাতে। তবে এখন মাঝেমধ্যে অ্যাথলেট কিংবা সেলিব্রিটিরাও আসেন বেল বাজাতে। গায়িকা লিজা মিনেলি, অলিম্পিক পদকজয়ী মাইকেল ফেল্‌প্‌স আর র‍্যাপার স্নুপ ডগ নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের বেল বাজিয়েছেন। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন সমাপনী বেল বাজিয়েছিলেন ২০১৩ সালে।