১৫৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ, দেশ ছাড়ার পর ব্যাংক হিসাব জব্দ

একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ও তার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা এই টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে বিএসইসির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।

অর্থ পাচার
প্রতীকী ছবি

দেশের শেয়ারবাজারে মিউচুয়াল ফান্ড বা তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাতের আরেক ঘটনা ঘটেছে। চারটি মিউচুয়াল ফান্ডে জমা থাকা প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের প্রায় ১৫৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন ফান্ডের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তি।

২০১৮ সাল থেকে একটু একটু করে তহবিল থেকে অর্থ সরিয়ে নেন ইউনিভার্সাল ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশনস (ইউএফএস) নামের সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হামজা আলমগীর। ভুয়া লেনদেন ও আর্থিক প্রতিবেদনে কারসাজির মাধ্যমে এ আত্মসাতের ঘটনা ঘটানো হয়।

দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে এ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটলেও তহবিলগুলোর দেখভালের দায়িত্বে থাকা ট্রাস্টি ও কাস্টডিয়ান বা হেফাজতকারী প্রতিষ্ঠান যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে হেফাজতকারী প্রতিষ্ঠানের ‘হেফাজতের’ ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ দায়িত্বে ছিল সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)।

আরও পড়ুন

জানতে চাইলে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তহবিলের আর্থিক বিষয়গুলো দেখভালের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে নিরীক্ষক নিয়োগ দেওয়া ছিল। সেই নিরীক্ষকের প্রতিবেদনের ওপর আমরা শতভাগ আস্থা রেখেছিলাম। তাই শুরুতে আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি আমরা বুঝতে পারিনি। পরে যখন বিএসইসির পক্ষ থেকে আমাদের আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি জানানো হয়, তাৎক্ষণিকভাবে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছি। এখানে আমাদের ভুল ছিল নিরীক্ষকের ওপর শতভাগ আস্থা রাখা।’

আর্থিক খাতে এ ধরনের ঘটনা আমরা কিছুদিন পরপরই ঘটতে দেখছি। কারণ, কোনো ঘটনায় কারও কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। যত দিন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে না, তত দিন এ ধরনের ঘটনাও বন্ধ হবে না।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক চেয়ারম্যান, বিএসইসি

অন্যদিকে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান বলছে, তহবিলগুলোর হেফাজতকারী হিসেবে আইসিবি দায়িত্বে থাকায় তারা ধরে নিয়েছিল যে সবকিছু ঠিকঠাক আছে। তাই কিছু বিষয়ে তাদের সন্দেহ হলেও আইসিবির কারণে সেসব বিষয়ে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বলছেন, ভুয়া আর্থিক প্রতিবেদনের বৈধতা দিয়েছে তহবিলগুলোর নিরীক্ষার দায়িত্ব থাকা নিরীক্ষক বা অডিটর। আর্থিক বিবরণীর গরমিল ধরার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে হিসাবের গরমিল তুলে ধরেনি। এ দায়িত্বে ছিল আহমেদ জাকের অ্যান্ড কোং ও রহমান মোস্তফা আলম অ্যান্ড কোং নামে দুটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান।

আরও পড়ুন

জানতে চাইলে আহমেদ জাকের অ্যান্ড কোংয়ের ব্যবস্থাপনা অংশীদার আহমেদ জাকের গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭-১৮ সালে তহবিলগুলোর দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই বড় অঙ্কের টাকা সরিয়ে নেয়। ওই সময় আমরা নিরীক্ষার দায়িত্বে ছিলাম না। পরে আমরা নিরীক্ষা করতে গিয়ে ব্যাংক হিসাবের তথ্য যাচাইয়ের জন্য প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে অথরাইজেশন বা কর্তৃত্ব চেয়ে চিঠি দিই। কিন্তু তারা তা দেয়নি। ফলে ব্যাংকের হিসাবের সঙ্গে আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য মিলিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া আইসিবি তহবিলগুলো হেফাজতকারীর দায়িত্বে থাকায় বিনিয়োগসংক্রান্ত যেসব তথ্য প্রতিষ্ঠানটি দিয়েছিল, সেগুলোর ওপর আমরা আস্থা রেখেছিলাম।’

আরও পড়ুন

বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে, আইসিবি ভরসা রেখেছে নিরীক্ষকের ওপর আর নিরীক্ষক আইসিবির ওপর আস্থা রেখে যথাযথভাবে সব তথ্য যাচাই-বাছাই করেনি। ফলে সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান ইউএফএস এ সুযোগে বিনিয়োগকারীদের অর্থ সরিয়ে নিয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে আত্মসাতের ঘটনা ঘটলেও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নজরে আসে তা গত জুনে। এরপরই বিএসইসি তদন্ত কমিটি গঠন করে। প্রাথমিক তদন্তে এর সত্যতাও খুঁজে পায়। তত দিনে অবশ্য অর্থ আত্মসাৎকারী বিদেশে পালিয়ে গেছেন।

বিএসইসির প্রাথমিক তদন্তে ১৫৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা আত্মসাতের তথ্য মিললেও ধারণা করা হচ্ছে, চূড়ান্ত তদন্তে আত্মসাৎ হওয়া অর্থের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। বিএসইসির তথ্য অনুযায়ী, চারটি তহবিল থেকে নগদ অর্থ সরানো হয়েছে ১২৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এ ছাড়া সুদ বাবদ ৩১ কোটি ৭৬ লাখ, ব্যবস্থাপনা ফির নামে ৭ কোটি ৯০ লাখ এবং ট্রাস্টি ফির নামে ৫৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা সরানো হয়েছে। এর মধ্যে অবশ্য বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে ৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

ইউএফএস হচ্ছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নিবন্ধিত একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান। যার অধীনে পাঁচটি মিউচুয়াল ফান্ড বা তহবিল পরিচালিত হয়। এসব তহবিলের আকার ৪৪০ কোটি টাকা। তহবিলগুলো হলো ইউএফএস পপুলার লাইফ ইউনিট ফান্ড, ইউএফএস আইবিবিএল শরিয়াহ ইউনিট ফান্ড, ইউএফএস ব্যাংক এশিয়া ইউনিট ফান্ড, ইউএফএস পদ্মা লাইফ ইসলামিক ফান্ড ও ইউএফএস প্রগতি লাইফ ইউনিট ফান্ড। এই পাঁচটি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে শেষটি বাদে বাকি চারটি তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটে।

ব্যাংক হিসাব জব্দ

এ ঘটনায় ইউএফএস-সংশ্লিষ্ট ১৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব ৩০ দিনের জন্য জব্দ করেছে। গতকাল মঙ্গলবারই এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা দেশের সব ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে।

যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব সাময়িকভাবে জব্দ করা হয়েছে, সেগুলো হলো ইউনিভার্সাল ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশনস (ইউএফএস), ইউএফএস আইবিবিএল শরিয়াহ ইউনিট ফান্ড, ইউএফএস পপুলার লাইফ ইউনিট ফান্ড, ইউএফএস ব্যাংক এশিয়া ইউনিট ফান্ড, ইউএফএস পদ্মা লাইফ ইসলামিক ফান্ড, ইশরাত আলমগীর, সৈয়দা শেহরীন হুসাইন, সৈয়দ আলমগীর ফারুক চৌধুরী, মাহিদ হক, তারেক মাসুদ খান, আলিয়া হক আলমগীর, মোহাম্মাদ জাকির হোসেন, সৈয়দ হামজা আলমগীর, সৈয়দা মেহরীন রহমান ও মোসা. উম্মে ইসলাম সোহানা।

জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বিএসইসির প্রাথমিক তদন্তে মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থ আত্মসাতের তথ্য মিলেছে। এ কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক হিসাব জব্দের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করা হয়। তার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব সাময়িকভাবে জব্দ করেছে। বিষয়টি নিয়ে এখনো তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জানা যায়, এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব থেকে ৩০ দিন কোনো ধরনের অর্থ উত্তোলন বা স্থানান্তরের নিষেধাজ্ঞা চেয়ে বিএসইসির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে আবেদন করা হয়। তার ভিত্তিতে বিএফআইইউ থেকে উল্লিখিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। এসব ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলন ও স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও অর্থ জমার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। অর্থাৎ ব্যাংক হিসাবগুলোতে অর্থ জমা করা যাবে, কিন্তু কোনো অর্থ উত্তোলন বা স্থানান্তর করা যাবে না।

শেয়ারবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডকে একধরনের নিরাপদ তহবিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থে গঠিত হয় এসব তহবিল। অন্যের টাকায় গঠিত তহবিলের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকে সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান। বিনিয়োগের নামে সাধারণ বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের অর্থ নানাভাবে অপব্যবহার করেছেন সম্পদ ব্যবস্থাপকেরা। এ কারণে মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা একেবারেই তলানিতে। নতুন করে ইউএফএসের এ ঘটনায় মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীদের অনাস্থা আরও বাড়াবে বলে মনে করেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এর আগে বেসিক ব্যাংকের বিপুল অঙ্কের অর্থ ঋণের নামে আত্মসাৎ করা হয়েছে। হলমার্ক নিয়ে গেছে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ‘পাচার’ করেছেন। এবার শেয়ারবাজারের মিউচুয়াল ফান্ডের টাকা আত্মসাতের ঘটনা সামনে এল।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন আমরা ব্যাংক থেকে নানা উপায়ে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা শুনতাম। এখন একই ধরনের ঘটনা শেয়ারবাজারেও দেখছি। ব্যাংক হোক বা শেয়ারবাজার হোক—এ ধরনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ আমানতকারী বা বিনিয়োগকারীরা। ফলে তাঁরা আস্থা হারান। আর্থিক খাতে এ ধরনের ঘটনা আমরা কিছুদিন পরপরই ঘটতে দেখছি। কারণ, কোনো ঘটনায় কারও কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। যত দিন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে না, তত দিন এ ধরনের ঘটনাও বন্ধ হবে না।’

এদিকে ইউএফএসের অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত সোমবার এ বিষয়ে রুলসহ এ আদেশ দেন। আগামী ৩০ দিনের মধ্যে বিএসইসি ও আইসিবিকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন হাইকোর্ট।